back to top
সোমবার, জুন ৩০, ২০২৫
HomeLifestyleRelationshipচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ: যখন সন্তান বড় হয়, বাবা-মা ছোট হয়ে যান

চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ: যখন সন্তান বড় হয়, বাবা-মা ছোট হয়ে যান

“বাবা, ঘুমোচ্ছো তো?”

রাত ২টা। নিঃশব্দে বাবার ঘরে ঢুকে বুকের ভেতর এক অজানা ভয় নিয়ে তার নিঃশ্বাস ওঠানামা দেখি। নিশ্বাসটা চললে তবেই যেন আবার নিজের বুক থেকে পাথর সরে।

এই দৃশ্যটা আজকাল বারবার ফিরে আসে। যারা এই বয়সে পৌঁছেছেন—৪০ থেকে ৫০-এর ঘরে, তারা বুঝবেন, এ বয়সটা এক ধরনের নীরব যন্ত্রণার নাম।

এই বয়সটা এত কষ্টের কেন?

এই বয়সে মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে নিজের জীবন নিয়ে—চাকরি, ব্যবসা, সংসার, সন্তান, স্কুল, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা… এর মাঝেই হঠাৎ করে একদিন চোখে পড়ে, বাবার হাত কাঁপে, মায়ের হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে, তাদের মুখের হাসিটা কেমন যেন ফ্যাকাসে।

যাদের ছায়ায় বড় হয়েছি, তারাই হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আগে যারা বকা দিতেন, শাসন করতেন, এখন তারাই চুপ করে থাকেন। তারাও বুঝে গেছেন—আমরা বড় হয়েছি। কিন্তু এ বড় হওয়া অনেক দাম দিয়ে কেনা।

ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া ভয়

এ বয়সের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা একটাই—“আমি কি হারাতে বসেছি আমার বাবা-মাকে?”

তারা হয়তো বেঁচে আছেন, কথা বলেন, খেতে পারেন। কিন্তু বয়স নামের এক ঠাণ্ডা ঝড় তাদের একটু একটু করে আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিচ্ছে।

যারা আমাদের একদিন শিখিয়েছিলেন, কিভাবে দাঁড়াতে হয়, হাঁটতে হয়, কথা বলতে হয়—আজ তারা চশমা খুঁজে পান না, টিভির রিমোট হাতে ধরিয়ে দিতে হয়, ওষুধ খাওয়ার সময় মনে করিয়ে দিতে হয়।

বদলে যাওয়া সম্পর্কের হিসেব

বাবা একদিন বললেন, “তোর মায়ের মনে হয় ভুলে যাওয়ার রোগটা শুরু হচ্ছে।”

কথাটা শুনে মনটা একদম কেঁপে উঠল। অথচ মা সেই মানুষ, যিনি এক সময় আমাদের স্কুলের সব রুটিন মুখস্থ রাখতেন, কী খেয়েছি, কী পরেছি সব জানতেন।

এখন সেই মা ভুলে যান গ্যাস বন্ধ করেছেন কি না, সেই বাবা রাতে কয়েকবার উঠে বসে বসে পানি খান—মনে হয় শরীরটা আর তার কথায় চলে না।

এ বয়সে এসে বুঝি, সম্পর্ক আর আগের মতো থাকে না। এখানে দায়িত্ব বদলে যায়। আগে বাবা-মা আমাদের দেখে রাখতেন, এখন আমরাই তাদের পাহারা দিই।

বাস্তবতার মুখোমুখি

বাংলাদেশে অনেক পরিবারেই এই বয়সে বাবা-মা অবসরে যান, আয় বন্ধ হয়। চিকিৎসা খরচ বাড়ে, একাকীত্বও চেপে বসে।

আমরাও নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত, টানাপড়েন থাকে সবখানে।

কিন্তু এর মধ্যেও, যখন তারা হঠাৎ একটা প্রশ্ন করেন—“তুই দুপুরে খেয়েছিস তো?”—তখন বোঝা যায়, বাবা-মা এখনও সন্তানকেই আগে ভাবেন।

এই ভালবাসাটাই পোড়ায় সবচেয়ে বেশি। কারণ আমরা জানি, সময়টা আর আগের মতো বেশি নেই।

কীভাবে সামলে রাখবেন নিজেকে এবং সম্পর্কটাকে

১. সময় দিন, যতটুকু পারেন: এক কাপ চা একসাথে খাওয়া, হালকা গল্প করা—এই ছোট ছোট সময়গুলোই একদিন বড় হয়ে দেখা দেবে।

২. ওষুধ আর চিকিৎসা নিয়ে সচেতন থাকুন: বয়স বাড়লে শরীর ভাঙবেই, কিন্তু আপনি যদি নিয়মিত নজরে রাখেন, ওষুধ আর রুটিন ঠিক রাখেন, তাহলে অনেক কষ্ট কমিয়ে আনা যায়।

৩. মানসিক প্রস্তুতি নিন: আপনি বড় হচ্ছেন মানে আপনার ছায়াগুলো ছোট হয়ে আসছে—এই সত্যটা মেনে নিতে শিখুন। কষ্ট হবে, কিন্তু মানিয়ে নিতে হবে।

৪. সন্তানদের শেখান এই সম্পর্কের মূল্য: তারা যেন বোঝে দাদা-দাদী বা নানা-নানীর যত্ন নেওয়া শুধু দায়িত্ব নয়, ভালোবাসাও।

৫. ভালোবাসা দেখাতে পিছপা হবেন না: বাবাকে জড়িয়ে ধরুন, মায়ের পায়ে হাত বুলিয়ে দিন। বিশ্বাস করুন, তারা সেটাই সবচেয়ে বেশি চায়—আপনার স্পর্শ, আপনার সময়।

এই বয়সে আমাদের জীবনের গতি সবচেয়ে বেশি, আর ঠিক তখনই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলো ধীরে ধীরে পিছনে পড়ে যাচ্ছেন। তারা আর কিছু চায় না। শুধু চায়—আপনি কখনো না ভোলেন যে, তাদের হাত ধরেই আপনি হেঁটে এসেছেন এতদূর।

তাদের সময় দিন, যত্ন নিন, ভালোবাসা দিন। কারণ একদিন এই মানুষগুলো আর থাকবে না, থাকবে শুধু আপনিই—নিজেকে বারবার দোষ দেবেন, “আরও একটু সময় দিলে হয়তো…”

চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বয়সটা বাজে না, কিন্তু এই সময়টায় আমরা জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটা সামনে থেকে দেখতে শুরু করি—ভালোবাসা আর মৃত্যুর মাঝে সময়টা খুবই ছোট। সেই সময়টুকু যেন আমরা অযথা নষ্ট না করি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular