আমরা ছোটবেলা থেকে গল্প শুনে বড় হই—ভালোবাসা নাকি সব ত্যাগের নাম, নিজের স্বপ্ন, নিজের ইচ্ছে, নিজের সময়—সবই ভালোবাসার মানুষটার জন্য বিলিয়ে দেওয়াই নাকি আসল সম্পর্কের প্রমাণ। কিন্তু আসলেই কি তাই?
অনেক সময় আমরা বুঝতেই পারি না, যে ভালোবাসার নামে আমরা নিজের সীমানা ভাঙছি, নিজের কণ্ঠকে চুপ করাচ্ছি, নিজের স্বপ্নকে গুটিয়ে নিচ্ছি—তা আসলে ভালোবাসা নয়, এটা নিজের প্রতি অবহেলা (self-abandonment)।
ভালোবাসা বনাম আত্ম-অবহেলা
ভালোবাসা আপনাকে যেমন, ঠিক তেমন করেই গ্রহণ করবে। সেখানে আপনাকে ছোট হতে হবে না, নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে না শুধু মানিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আত্ম-অবহেলায় আপনি ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলেন—আপনার পছন্দ-অপছন্দ, সীমারেখা (boundaries) সব যেন মুছে যেতে থাকে।
ভাবুন তো—
- আপনি কি সবসময় নিজের কথা বলার আগে ভেবে নেন, “ও রাগ করবে কিনা?”
- নিজের পছন্দের কাজগুলো কি বন্ধ করে দিয়েছেন, কারণ আপনার সঙ্গী সেটা পছন্দ করে না?
- আপনার মন খারাপ হলেও কি জোর করে হাসিমুখে থাকেন, যাতে সম্পর্কটা ঠিক থাকে?
যদি উত্তর “হ্যাঁ” হয়, তবে আপনাকে ভাবতে হবে—এটা কি সত্যিই ভালোবাসা? নাকি আপনি ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্ব মুছে দিচ্ছেন?
সঠিক সম্পর্কের রূপ
একটি সুস্থ সম্পর্ক কখনোই আপনাকে আপনার সীমারেখা ভাঙতে বলবে না। বরং সেটি আপনার ব্যক্তিত্বকে সম্মান করবে।
- আপনি যেমন আছেন, ঠিক তেমনভাবেই আপনাকে গ্রহণ করবে।
- আপনার স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, বন্ধুত্ব—সবকিছুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
- আপনাকে বদলানোর চেষ্টা করবে না, বরং আপনাকে নিজের সেরা রূপে পৌঁছাতে উৎসাহ দেবে।
সঠিক সম্পর্কের জন্য আপনাকে ভালোবাসা “অর্জন” করতে হয় না অতিরিক্ত ত্যাগ বা overgiving দিয়ে।
নিজেকে হারিয়ে ফেলার গল্প
শারমিন, ঢাকার এক প্রাইভেট কোম্পানির কর্মী, ভালোবেসে বিয়ে করেছিল কলেজ জীবনের বন্ধুকে। বিয়ের পর শুরুর দিকে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে লক্ষ্য করল, তার স্বামী চাইছে শারমিন যেন তার সব সময় ও শক্তি শুধু সংসারের জন্য দেয়। অফিসের প্রোমোশনের সুযোগ পেলেও শারমিন রাজি হয়নি, কারণ স্বামী বলেছিল “তুমি এত ব্যস্ত হলে আমাদের সময় কোথায় হবে?”
বছরের পর বছর ধরে নিজের ক্যারিয়ারের স্বপ্ন, নিজের শখ—সবকিছু ছেড়ে দিয়ে শারমিন সম্পর্কটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু একদিন সে বুঝল, সম্পর্কটা টিকে আছে শুধু তার ত্যাগের উপর—যেখানে তার নিজের জন্য কোনো জায়গা নেই। তখনই সে প্রথমবার ভাবল, “এটা কি সত্যিই ভালোবাসা?”
নিজেকে বেছে নেওয়ার শক্তি
যখন আপনি দৌড়ানো বন্ধ করেন—সবসময় প্রমাণ করার চেষ্টা বন্ধ করেন—তখনই জীবনে বড় কিছুর জন্য জায়গা তৈরি হয়। সেটা হতে পারে এক সুন্দর, সম্মানজনক সম্পর্ক… অথবা নিজের প্রতি নতুন করে ভালোবাসা।
নিজেকে বেছে নেওয়া মানে selfish হওয়া নয়। বরং, আপনি যখন নিজের প্রতি যত্নবান হন, নিজের সীমারেখা রক্ষা করেন, তখনই আপনি অন্যকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারেন।
কীভাবে বুঝবেন আপনি Self-Abandonment-এ আছেন?
- নিজের চাহিদা ও অনুভূতি উপেক্ষা করা – সবসময় অন্যের প্রয়োজন আগে রাখা।
- সবসময় শান্তি রক্ষাকারী ভূমিকা নেওয়া – সমস্যার কথা না বলে চুপ থাকা, যাতে ঝগড়া না হয়।
- নিজের প্যাশন বা শখ ছেড়ে দেওয়া – কারণ সঙ্গী সেটা পছন্দ করে না।
- প্রমাণের জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করা – সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সব দায়িত্ব একাই নেওয়া।
সুস্থ সম্পর্ক গড়তে যা করবেন
- নিজের সীমারেখা স্পষ্ট করে বলুন।
- “না” বলা শিখুন—এটা রূঢ়তা নয়, এটা নিজের প্রতি সম্মান।
- নিজের বন্ধু, শখ, স্বপ্নের সাথে যুক্ত থাকুন।
- সম্পর্কের মধ্যে সমান দায়িত্ব ও সম্মান নিশ্চিত করুন।
ভালোবাসা কখনোই এমন কিছু নয় যা আপনাকে নিজের সীমা ভাঙতে বাধ্য করে বা আপনার অস্তিত্বকে মুছে ফেলে। সত্যিকারের ভালোবাসা সেই যা আপনাকে আরও শক্তিশালী করে, আপনার স্বপ্নগুলোর দিকে ঠেলে দেয় এবং আপনার স্বাধীনতা বজায় রাখে।
নিজেকে হারিয়ে দিয়ে, শুধু কারও জীবনে জায়গা পাওয়ার জন্য দৌড়ানো মানে নিজের প্রতি অবিচার। সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত যেখানে আপনি যেমন, ঠিক তেমন করেই ভালোবাসা পাবেন—না যে আপনাকে বদলে নিতে হবে, না যে আপনাকে নিজের আনন্দ, স্বপ্ন বা সীমারেখা বিসর্জন দিতে হবে।
যখন আপনি নিজেকে বেছে নিতে শুরু করবেন, তখনই আপনি দেখবেন—আপনার চারপাশের সম্পর্কগুলো বদলে যাচ্ছে। কারণ আপনি যখন নিজের প্রতি ভালোবাসা দেখান, তখনই আপনি প্রকৃত ভালোবাসা চেনার এবং গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করেন।
মনে রাখবেন, যে সম্পর্ক আপনাকে নিজেকে ছোট করতে শেখায়—সেটি কখনোই ভালোবাসা নয়। আর যে সম্পর্ক আপনাকে নিজের আসল রূপে বাঁচতে শেখায়—সেটিই আপনার সত্যিকারের আশ্রয়।