সাম্প্রতিক সময়ে আমি ব্রুস ওয়েইনস্টাইনের একটি প্রবন্ধ পড়েছি, যেখানে তিনি “Should vs Would”—এই দুটি প্রশ্নের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। ওয়েইনস্টাইন “Ethical Intelligence” এবং “The Good Ones” এর মতো বইয়ের লেখক এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তাঁর এই আলোচনা প্রথমে “নাইট রাইডার ট্রিবিউন” এবং পরে “ক্যান্সেসিটি ডট কম” এ প্রকাশিত হয়।
ওয়েইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— “আপনি কী করবেন?” (What would you do?) এবং “আপনার কী করা উচিত?” (What should you do?)—এই দুটি প্রশ্নের মধ্যে পার্থক্য কী? তাঁর ব্যাখ্যা সহজবোধ্য কিন্তু গভীর। চলুন দেখে নিই, বিষয়টি কীভাবে বাস্তব জীবনে প্রভাব ফেলে।
মানবিকতা বনাম নৈতিকতা
ওয়েইনস্টাইনের মতে, “আপনি কী করবেন?” প্রশ্নটি মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মানবিক আচরণ বিশ্লেষণ করে। আমরা কেন কোনো সিদ্ধান্ত নিই, সেটি বুঝতে এই প্রশ্নটি সাহায্য করে। অপরদিকে, “আপনার কী করা উচিত?” প্রশ্নটি নৈতিকতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে, যা আমাদের সঠিক বা ভুল সিদ্ধান্ত বোঝাতে সাহায্য করে।
মানবিকতা এমন এক গুণ, যা মানুষকে অন্য প্রাণীদের তুলনায় আলাদা করে এবং উন্নত মনন গঠনে সহায়তা করে। কিন্তু নৈতিকতা আমাদের বিবেক ও বোধশক্তির জাগরণ ঘটায়, যা সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমাদের চিন্তাভাবনায় সতর্কতা আনা প্রয়োজন।
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
এই পার্থক্য বুঝতে একটি সাধারণ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরুন, আপনি একজন অভিভাবক এবং আপনার সন্তানের কাছে জানতে চান— “তুমি যদি কাউকে পরীক্ষায় নকল করতে দেখ, তাহলে কী করবে?” (What would you do?) বেশিরভাগ শিশু হয়তো বলবে, তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাবে এবং শিক্ষকের কাছে জানাবে না। কিন্তু যদি প্রশ্নটি একটু পাল্টে বলা হয়— “তুমি যদি কাউকে নকল করতে দেখ, তাহলে তোমার কী করা উচিত?” (What should you do?) তখন উত্তরটি বদলে যেতে পারে। কারণ, এই প্রশ্ন তার বিবেককে নাড়া দেবে এবং নৈতিকভাবে সঠিক উত্তর দিতে উদ্বুদ্ধ করবে।
এই সামান্য পরিবর্তনই আমাদের চিন্তাধারায় বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। মানবিক আচরণ ও নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যে এই সূক্ষ্ম পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
একটি শব্দ বদলে দিতে পারে দৃষ্টিভঙ্গি
ওয়েইনস্টাইনের মতে, আমরা যখন কাউকে সাহায্যের জন্য বলি— “তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?” তখন সে হয়তো ব্যস্ততা বা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে না বলতে পারে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়— “তুমি কী মনে করো, আমার কী করা উচিত?” তাহলে সে নিজের চিন্তাভাবনার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে এবং সাহায্য করার প্রবণতা বাড়তে পারে। কারণ, “উচিত” শব্দটি তার বিবেক ও দায়িত্ববোধকে সক্রিয় করে।
এই কৌশল শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কেই নয়, বরং কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা, এমনকি নেতৃত্বগুণের ক্ষেত্রেও কার্যকর হতে পারে। যখন আপনি কাউকে দায়িত্বশীল করার চেষ্টা করবেন, তখন সরাসরি আদেশ না দিয়ে এমনভাবে প্রশ্ন করুন যাতে সে নিজেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন আনুন
ওয়েইনস্টাইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, “আপনি কী করবেন?” প্রশ্নটি আবেগ এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উত্তর দেয়। পক্ষান্তরে, “আপনার কী করা উচিত?” প্রশ্নটি নৈতিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।
আমাদের নিজেদের কথার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আবেদন তৈরি করতে হবে, যাতে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। এটি শুধু একটি কৌশল নয়, বরং একটি শক্তিশালী উপায় যা আমাদের জীবন ও কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকরী হতে পারে।
আমাদের প্রতিদিনের সিদ্ধান্তগুলো অনেকাংশে নির্ভর করে আমরা কীভাবে প্রশ্ন করি এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে গঠিত হয়। ব্রুস ওয়েইনস্টাইনের বিশ্লেষণ আমাদের শেখায় যে, ছোট একটি শব্দ পরিবর্তন করলেই বড় পরিবর্তন আসতে পারে। কথার যথাযথ ব্যবহার আমাদের চিন্তাধারা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারে।
পরিশেষে, উইলিয়াম শেরউড ফক্সের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি—
“আমরা একটি সহজ প্রশ্ন করবো এবং আমাদের ইচ্ছা শুধু তাই; জেলেরা কি সব মিথ্যাবাদী হয়? নাকি জেলে হয় শুধু মিথ্যাবাদীরাই?”
এই পার্থক্য বুঝতে পারলে, জীবনের অনেক প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।