মঙ্গলবার, জুলাই ২৯, ২০২৫
HomeLifestyleHealthy Livingস্তন ক্যান্সার: বাংলাদেশি নারীদের জন্য জরুরি সচেতনতার বার্তা

স্তন ক্যান্সার: বাংলাদেশি নারীদের জন্য জরুরি সচেতনতার বার্তা

“স্তনে হালকা ব্যথা লাগছে, কিন্তু গুরুত্ব দিচ্ছি না।”

এটাই হচ্ছে সেই ভুল, যা হাজারো নারী প্রতিদিন করে যাচ্ছেন।

৩৮ বছরের রোকসানা বেগমও তাই করেছিলেন। মাসের পর মাস ধরে ডান স্তনের ছোট্ট গোঁটাকে অবহেলা করেছিলেন। পরে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে জানা গেল—এটি স্তন ক্যান্সার, আর সেটি শেষ পর্যায়ে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজারেরও বেশি নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য বলছে, সচেতনতার অভাব ও দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে ৫০ শতাংশ রোগী মারা যান। অথচ প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে স্তন ক্যান্সার ১০০% নিরাময়যোগ্য।

  • কারা বেশি ঝুঁকিতে?
  • কোন কোন লক্ষণ আগে থেকেই চিনে রাখা দরকার?
  • কীভাবে নিজে পরীক্ষা করবেন?
  • আর প্রতিরোধে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে জীবনযাপনে?

কারা বেশি ঝুঁকিতে?

ডাক্তারদের মতে, যে কেউ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে কিছু নারীর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি:

  • ১২ বছরের আগেই ঋতুস্রাব শুরু হলে।
  • দেরিতে মেনোপজ বা ঋতু বন্ধ হলে।
  • সন্তান না থাকলে অথবা দেরিতে সন্তান নিলে।
  • বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ালে।
  • দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা হরমোন ইনজেকশন ব্যবহার করলে।
  • অতিরিক্ত প্রাণীজ আমিষ ও তেল-চর্বি খেলে।
  • ওজন বেশি হলে বা স্থূলতা থাকলে।

বাংলাদেশে অনেক নারী এসব ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন না। ফলে রোগের আগেই সচেতন হওয়ার সুযোগ হারান।

স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ:

প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু লক্ষণ খেয়াল করলেই জীবন বাঁচতে পারে—

  • স্তনে শক্ত চাকা বা গোঁটা তৈরি হওয়া।
  • স্তনের বোঁটার আকার বা অবস্থার পরিবর্তন (ভেতরে ঢুকে যাওয়া বা বাঁকা হয়ে যাওয়া)।
  • বোঁটা থেকে অস্বাভাবিক তরল বের হওয়া।
  • স্তনের চামড়ার রঙ বা গঠনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন।
  • বাহুমূল বা বগলে গোঁটা বা পিণ্ড অনুভব হওয়া।

যে কোনো একটি লক্ষণ পেলেই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

কেন আগেভাগে শনাক্তকরণ এত জরুরি?

বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার রোগীদের বড় একটি অংশ হাসপাতালে যান শেষ পর্যায়ে।

প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়।

তবে দেরি করলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গে। তখন চিকিৎসা অনেক কঠিন এবং ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।

নিজেকে পরীক্ষা করার সহজ উপায় (Breast Self-Examination):

প্রতি মাসে অন্তত একবার নিজে পরীক্ষা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

  1. আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্তনের আকার ও রঙে পরিবর্তন লক্ষ্য করুন।
  2. হাত দিয়ে স্তন হালকা চেপে দেখুন, কোনো গোঁটা বা অস্বাভাবিক শক্ত কিছু আছে কিনা।
  3. বোঁটা থেকে কোনো তরল বা রস বের হচ্ছে কিনা তা দেখুন।

৩০ বছরের পর প্রতি বছর ম্যামোগ্রাফি বা আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করানো ভালো।

জীবনযাপনে পরিবর্তন আনুন:

  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা শারীরিক কার্যকলাপ করুন।
  • সুষম খাবার খান: বেশি করে শাকসবজি, ফল, আঁশযুক্ত খাবার খান, ফাস্টফুড ও অতিরিক্ত তেল এড়িয়ে চলুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন।
  • সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান।
  • ধূমপান, অ্যালকোহল এবং অপ্রয়োজনীয় হরমোন ওষুধ থেকে দূরে থাকুন।

বাস্তব গল্প – অনুপ্রেরণা:

নারায়নগঞ্জের সাদিয়া আপা বলেন,

“আমি প্রথমে ভেবেছিলাম স্তনের ছোট গোঁটা কিছুই না। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে গিয়ে জানতে পারি এটি ক্যান্সার। সৌভাগ্যবশত প্রথম স্টেজেই ধরা পড়ায় চিকিৎসার পর এখন আমি একদম ভালো আছি।”

এই গল্প আমাদের শেখায়—সমস্যা অবহেলা না করে আগেভাগে ব্যবস্থা নেওয়াই জীবন বাঁচানোর সঠিক পথ।

সমাজ ও সচেতনতার ভূমিকা:

বাংলাদেশে অনেকেই স্তন ক্যান্সারকে এখনো লজ্জার বিষয় মনে করেন। কেউ পরীক্ষা করাতে ভয় পান, কেউ খোলাখুলি আলোচনা করেন না।

এমন সময় দরকার—

  • গ্রামে-শহরে সচেতনতা কর্মসূচি চালানো।
  • ফ্রি ব্রেস্ট এক্সামিনেশন ক্যাম্প আয়োজন।
  • মেয়েদের স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা বাড়ানো।

জীবনের জন্য ছোট্ট পদক্ষেপ

স্তন ক্যান্সার নিয়ে ভয় নয়, দরকার সচেতনতা, আগাম পদক্ষেপ ও নিয়মিত যত্ন। আজ যদি আপনি নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তা শুধু আপনাকেই নয়, আপনার পরিবারকেও সুরক্ষিত করবে।

প্রতি মাসে ৫ মিনিট সময় দিন নিজের জন্য। আয়নার সামনে দাঁড়ান, ছোট্ট কিছু পরিবর্তনও উপেক্ষা করবেন না। মনে রাখুন, ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে তা ১০০% নিরাময়যোগ্য।

বাংলাদেশে এখনো অনেক নারী লজ্জা, ভয় বা অবহেলার কারণে ডাক্তারের কাছে দেরিতে যান। এই মানসিকতা ভাঙতে হবে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজকে নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো আমাদের দায়িত্ব।

আজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করুন:

  • প্রতি মাসে নিজে পরীক্ষা করবো।
  • পরিবার ও বন্ধুকে সচেতন করবো।
  • যে কোনো লক্ষণ পেলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যাবো।

জীবন অমূল্য। একবার অসচেতনতার কারণে প্রিয়জনকে হারানোর চেয়ে, আগেভাগে যত্ন নেওয়া হাজার গুণ ভালো।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular