আপনি কি ব্যস্ত? প্রশ্নটা একটু কেমন শোনায়, তাই না? ঢাকার যানজট, অফিসের চাপ, কিংবা ঘরে সংসারের দায়িত্ব—এসব সামলে সুস্থ থাকার জন্য দিনে ঘণ্টাখানেক সময় বের করা যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই কঠিন। সকালে উঠে বা সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে প্রায় ১০ হাজার কদম (যা সাধারণত প্রায় ৮০ মিনিট বা দেড় ঘণ্টা হাঁটা) হাঁটার কথা মনে এলেই মনে হয়, “ধুর, আমার দ্বারা হবে না!”
বিজ্ঞান ও ফিটনেস বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, সময় ও উপযোগিতার এই সমীকরণটি পাল্টে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো হাঁটার দূরত্ব নয়, বরং আপনি আপনার শরীরকে কতটা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। এই ছোট, তীব্র প্রচেষ্টা আমাদের শরীর ও মনে এতটাই প্রভাব ফেলে যে, তা দীর্ঘ সময়ের হাঁটার চেয়েও কার্যকর হতে পারে। আজকের লেখায় আমরা জানব, কীভাবে আপনি আপনার ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে মাত্র ১০ মিনিটের একটি ‘ম্যাজিক ফর্মুলা’ ব্যবহার করে সুস্থ ও ফিট থাকতে পারেন, যা আপনার ১০ হাজার কদমের দুশ্চিন্তা দূর করে দেবে।
১০ হাজার কদমের ভুল ধারণা:
প্রথমে একটা জরুরি তথ্য জানা দরকার—দৈনিক ১০ হাজার কদম হাঁটার ধারণাটি কিন্তু কোনো প্রাচীন বৈজ্ঞানিক সূত্র থেকে আসেনি। এর জন্ম হয়েছে ১৯৬০-এর দশকে জাপানে, টোকিও অলিম্পিকের আগে। এটি ছিল একটি স্টেপ-কাউন্টিং যন্ত্র বা পেডোমিটারের প্রচারমূলক স্লোগান, যার নাম ছিল ‘মানপো-কেই’ (Manpo-Kei), যার অর্থ ‘১০ হাজার কদমের মিটার’।
এই ধারণাটি জনপ্রিয় হলেও বিজ্ঞানীরা দেখছেন, উপকারিতা পেতে হলে আসলে সবার জন্য ১০ হাজার কদমের প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে, যাঁরা কম সক্রিয়, তাঁদের জন্য ৮ হাজার কদমই যথেষ্ট হতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে। সমস্যা হলো: ১০ হাজার কদম হাঁটতে গেলে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের মতো কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য এটি একটা মানসিক চাপ তৈরি করে—হয়তো আমরা হাঁটা শুরুই করি না এই ভয়ে যে, এত সময় দিতে পারব না!
এখান থেকেই আসে আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন কৌশল: তীব্রতা (Intensity) সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।
১০ মিনিটের কৌশল: হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং (HIIT)
মাত্র ১০ মিনিটে ১০ হাজার কদমের চেয়ে বেশি উপকার পাওয়ার মূল চাবিকাঠি হলো হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিং (HIIT) বা বাংলায় যাকে বলা যায় ‘উচ্চ-তীব্রতার বিরতিমূলক প্রশিক্ষণ’।
HIIT হলো এমন ব্যায়াম, যেখানে আপনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনার সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে খুব দ্রুত একটি ব্যায়াম করেন (যেমন ৩০ সেকেন্ড), তারপর স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নেন (যেমন ১৫-৩০ সেকেন্ড)। এভাবে কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, আলভি (ধরুন ঢাকার কোনো ব্যস্ত চাকুরিজীবী) যদি সকালে ১৫ মিনিট হেঁটে অফিস যান, তিনি কার্ডিও (হৃৎপিণ্ডের ব্যায়াম) করছেন। কিন্তু যদি তিনি মাত্র ১০ মিনিটের জন্য দ্রুত জাম্পিং জ্যাক (Jumping Jack) বা স্কোয়াট (Squat) করেন এবং এর মাঝখানে ছোট বিরতি নেন, তবে তার শরীর অনেক দ্রুত ও বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
HIIT কেন হাঁটার চেয়ে দ্রুত ফল দেয়?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, HIIT-এর এই কৌশল তিনটি মূল উপায়ে শরীরকে প্রভাবিত করে, যা দীর্ঘ সময়ের হাঁটায় সহজে ঘটে না:
১. হার্টের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি (VO2 Max):
যখন আপনি দ্রুত, তীব্র ব্যায়াম করেন, তখন আপনার হার্টকে শরীরের প্রতিটি অংশে অক্সিজেন পৌঁছানোর জন্য খুব দ্রুত কাজ করতে হয়। এর ফলে আপনার VO2 Max বা সর্বোচ্চ অক্সিজেন ব্যবহারের ক্ষমতা দ্রুত বাড়ে। সহজ কথায়, আপনার হার্ট ও ফুসফুস অল্প সময়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ধীর গতির হাঁটার চেয়ে তীব্র ব্যায়াম অনেক বেশি কার্যকর।
২. মেটাবলিজম বা বিপাক ক্ষমতা বৃদ্ধি (Afterburn Effect):
HIIT-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো EPOC (Excess Post-exercise Oxygen Consumption), যা সাধারণ বাংলায় ‘আফটারবার্ন ইফেক্ট’ নামে পরিচিত। তীব্র ব্যায়ামের পরে শরীরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে অনেক বেশি শক্তি খরচ করতে হয়। এর ফলে ব্যায়াম শেষ হওয়ার পরেও আপনার শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্যালোরি বার্ন করতে থাকে, যা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ১০ হাজার কদম ধীর গতিতে হাঁটলে এই প্রভাব খুব কম দেখা যায়।
৩. ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ:
আধুনিক জীবনে বসে থাকার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বল্প সময়ের তীব্র মাংসপেশীর কার্যকলাপ রক্তের শর্করা (Blood Sugar) নিয়ন্ত্রণকে দীর্ঘ সময়ের ধীর গতির হাঁটার চেয়েও কার্যকরভাবে উন্নত করতে পারে।
ব্যস্ত বাঙালির জন্য ‘১০ মিনিটের রুটিন’: ঘরের মধ্যেই জিম!
ঢাকার জিম বা পার্কগুলোতে যাওয়ার সময় নেই? সমস্যা নেই। আপনার ঘরের মধ্যে মাত্র ১০ মিনিটের জন্য একটি কার্যকর HIIT রুটিন তৈরি করা সম্ভব। এটি শুরু করার আগে অবশ্যই শরীরকে প্রস্তুত করতে ২ মিনিটের ওয়ার্ম-আপ করে নেবেন।
মোট সময়: ৩ x (৩০ সেকেন্ড কাজ + ১৫ সেকেন্ড বিশ্রাম) x ৩টি ব্যায়াম = ৪ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড (প্রায় ৫ মিনিট) + অতিরিক্ত বার্পি বা ক্লাইম্বার = সর্বমোট ১০ মিনিটের কাছাকাছি।
এই ১০ মিনিট যদি আপনি মন দিয়ে করতে পারেন, তবে আপনি আপনার হার্ট রেটকে এতটাই বাড়িয়ে তুলবেন যে, তা দীর্ঘ সময়ের ধীর গতির হাঁটার চেয়েও দ্রুত হৃৎপিণ্ড এবং মেটাবলিজমের উন্নতি ঘটাবে।
সিঁড়ি যদি আপনার কাছে না থাকে বা হাঁটুতে সমস্যা থাকে, চিন্তা নেই। বিকল্প high-intensity ব্যায়াম যেমন সাইকেল চালানো, সাঁতার, দড়ি লাফ, kickboxing বা নাচ—এগুলো সবই অল্প সময়ে বেশি ক্যালোরি পোড়ায় এবং হার্টের জন্য উপকারী।
নিয়মিত ১০ মিনিট উচ্চমানের ব্যায়ামের সুবিধা:
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়: একটি মেটা-অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা cardiovascular mortality ৩৫% এবং all-cause mortality ৩০% কমায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: গবেষণায় দেখা গেছে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ওজন কমায়, শরীরের চর্বি কমায় এবং HDL (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়ায়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ: নিয়মিত ব্যায়াম রক্তের শর্করা এবং insulin sensitivity উন্নত করে।
মানসিক স্বাস্থ্য: ব্যায়ামে endorphins নিঃসৃত হয় যা মন ভালো রাখে, stress কমায়।
হাড় শক্ত করে: সিঁড়ি বেয়ে ওঠা weight-bearing exercise, যা বয়স্কদের জন্য osteoporosis প্রতিরোধে সাহায্য করে।
শুধু শরীর নয়, মানসিক শান্তিও
১০ হাজার কদম হাঁটা অবশ্যই একটি চমৎকার অভ্যাস, বিশেষ করে মানসিক প্রশান্তি এবং প্রকৃতির সাথে যুক্ত থাকার জন্য। কিন্তু যদি আপনার জীবন আপনাকে এতটুকু সময় দিতে না পারে, তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
এই দ্রুতগতির যুগে, আপনাকে শুধু স্মার্ট হতে হবে। রুটিনকে কঠিন করবেন না, রুটিনকে করুন কার্যকর (Effective)। আপনার ১০ মিনিটের তীব্র পরিশ্রম আপনাকে দেবে শক্তিশালী হৃদয়, উন্নত মেটাবলিজম এবং আত্মবিশ্বাসী মন—যা ১০ হাজার কদমের চেয়েও বেশি মূল্যবান। আপনার জীবন থেকে মাত্র ১০ মিনিট চুরি করে, নিজের জন্য বিনিয়োগ করুন। ফলাফল দেখে আপনি নিজেই অবাক হবেন!