সকাল ৮টা। হঠাৎ, ফোনে মেইলের নোটিফিকেশন। বস অফিস মিটিংয়ের সময় আগিয়ে এনেছেন। মাথায় যেন টান টান একটা তার টানছে। আরেকটা দিন শুরু হলো দমবন্ধ করা স্ট্রেস নিয়ে।
আমরা এমনই এক সমাজে বাস করি, যেখানে ‘ব্যস্ত থাকা’ হলো গর্বের বিষয় আর ‘আরাম খোঁজা’ যেন অলসতার নামান্তর। অথচ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, স্ট্রেস এখন বিশ্বের অন্যতম নীরব মহামারি। এমনকি অ্যামেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক রিপোর্ট বলছে— ৭৫% মানুষ স্ট্রেস-সম্পর্কিত শারীরিক বা মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যান। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই ছুটে চলার জীবনে আমরা কি সত্যিই স্ট্রেসের কাছে হার মেনে নিয়েছি? নাকি এর বিরুদ্ধে লড়ার কিছু বাস্তব কৌশল আছে?
চলুন, এক সাধারণ কর্মজীবী রাফিনের গল্প দিয়ে শুরু করি।
রাফিনের রুটিন, আর তার ভাঙন
রাফিন, রাজধানীর এক মিডিয়াতে কাজ করেন। সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা— ব্যস্ততা, চাপ, শিডিউল মিলিয়ে জীবন যেন এক ছকে বাঁধা গল্প। প্রথমে বুঝতে পারেননি, কেন সবসময় ক্লান্ত লাগে, রাতে ঘুম আসে না, কিংবা ছোট বিষয়েও বিরক্তি তৈরি হয়।
একদিন অফিসে এক সহকর্মী হঠাৎ বললেন, “তুই নিজের জন্য কিছু করিস না কেন?” কথাটা তখন তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হলো— সত্যিই তো, “নিজের জন্য” বলতে জীবনে যেন কিছুই নেই!
সেদিন থেকে শুরু রাফিনের “স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট”-এর যাত্রা।
১. নিঃশ্বাস নেওয়ার অনুশীলন: এক মুহূর্তের ম্যাজিক
সবচেয়ে সহজ অথচ সবচেয়ে উপেক্ষিত টেকনিক— শ্বাসপ্রশ্বাস। অ্যামেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী, প্রতি মিনিটে কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া রক্তচাপ কমায়, মনকে শান্ত করে এবং কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) কমায়।
রাফিন প্রতিদিন ভোরে ৫ মিনিট করে “৪-৭-৮” নিঃশ্বাস নেওয়ার অনুশীলন করেন। মাত্র তিন সপ্তাহে তার ঘুমের মান অনেকটাই বেড়েছে।
২. ডিজিটাল ডিটক্স: অন্তত এক ঘন্টা নিজের জন্য
Global Wellness Institute বলছে, দিনের কিছুটা সময় প্রযুক্তির বাইরে থাকা স্ট্রেস কমাতে দারুণ কার্যকর।
রাফিন এখন রাত ১০টার পর মোবাইল হাতে নেন না। তার বদলে গল্পের বই, বা সাদামাটা ডায়েরিতে নিজের অনুভূতি লেখেন। এটি তার মানসিক স্বস্তি এনে দিয়েছে।
৩. চলাফেরার মাধ্যমে নিজেকে সচল রাখুন
মার্কিন Mayo Clinic গবেষণা বলছে— মাত্র ২০ মিনিট হাঁটা, জগিং বা ইয়োগা মস্তিষ্কে এনডরফিন হরমোন বাড়ায়, যাকে বলা হয় “হ্যাপিনেস কেমিক্যাল”।
রাফিন এখন সন্ধ্যার পরে ১৫ মিনিট পাড়ায় হাঁটেন। শুধু হাঁটেন না, নিজের সঙ্গে কথা বলেন— “আজ কেমন কেটেছে?” এরকম ছোট ছোট প্রশ্ন তার মনের খাঁচা খুলে দেয়।
৪. ‘না’ বলার শিল্প শিখুন
রাফিন আগে সবকিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলতেন। সহকর্মীর কাজ, বাড়ির দায়িত্ব, আত্মীয়দের অনুরোধ— সব সামলাতে গিয়ে তিনি নিজেকেই ভুলে গিয়েছিলেন।
তবে এখন, তিনি বুঝেছেন— সবকিছু করা সম্ভব না। কিছু ‘না’ বলতেই হবে, যেন নিজের মানসিক জায়গাটা বাঁচে।
৫. নিয়মিত আত্ম-মূল্যায়ন
Harvard Business Review-এর এক গবেষণায় বলা হয়— যারা সপ্তাহে অন্তত একদিন নিজেদের সময় দেয়, তারাই দীর্ঘমেয়াদে কর্মক্ষেত্রে বেশি সফল হয়।
রাফিন প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজেকে ৩০ মিনিট সময় দেন। পেছনে তাকান, আত্মবিশ্লেষণ করেন— কোথায় ক্লান্ত লাগছে, কী আনন্দ দিয়েছে।
শেষ কথাঃ স্ট্রেস থাকবে, কিন্তু আপনিও তো আছেন
স্ট্রেস থাকবে। অফিস থাকবে। সময়ের চাপে ঘাড়ে নিঃশ্বাস পড়বে। কিন্তু এই মুহূর্তেই আপনি চাইলে নিজের জন্য কিছু করতে পারেন।
আপনার দিনের শুরুর ১০ মিনিট যদি আপনি নিজের মনের জন্য রাখেন— সেটাই আপনার স্ট্রেসের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরক্ষা।
কথা হচ্ছে— আপনি নিজেকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন?