আজকের শিশুদের বড় একটি অংশ দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে সময় কাটায়—কার্টুন, গেম, ভিডিও, ট্যাবলেট এবং মোবাইল অ্যাপ। ব্যস্ত জীবনে এটি বাবা–মায়ের জন্য সুবিধাজনক সমাধান মনে হলেও, গবেষণা বলছে—এটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স নির্দেশিকা অনুযায়ী—
-
২ বছরের কম বয়সে স্ক্রিনটাইম = শূন্য
-
২–৫ বছরের শিশু = দিনে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা
কিন্তু বাস্তবে অনেক শিশু প্রতিদিন ৩–৪ ঘণ্টা স্ক্রিন দেখে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স গবেষণা জানায়—শিশুর মস্তিষ্ক জন্মের পর প্রথম ৫ বছরে ৯০% বিকাশ সম্পন্ন করে, এবং এই সময় বাস্তব অভিজ্ঞতা স্ক্রিনের তুলনায় বহুগুণ বেশি প্রভাব ফেলে।
হার্ভার্ড গবেষকদের মতে, নিম্নের ৮টি স্ক্রিনমুক্ত অভ্যাস শিশুর ভাষা, বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে সবচেয়ে কার্যকর।
১. প্রতিদিন বই পড়া—ভাষা এবং কল্পনাশক্তির ভিত্তি
হার্ভার্ড সেন্টার অন দ্য ডেভেলপিং চাইল্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের পর থেকেই যেসব শিশুকে নিয়মিত বই পড়ে শোনানো হয়, তাদের vocabulary ৫ বছর বয়সে অন্যদের চেয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন শব্দ বেশি থাকে।
কেন এত শক্তিশালী?
বই পড়ার সময় শিশুর মস্তিষ্কের একাধিক অংশ সক্রিয় হয়—শোনা, বোঝা, কল্পনা করা, আবেগ অনুভব করা। টিভিতে কার্টুন দেখলে শুধু passive reception হয়, কিন্তু বই শিশুকে active participant করে তোলে।
কীভাবে শুরু করবেন:
- ৬ মাস থেকেই ছবিওয়ালা বই দেখান (বোর্ড বুক)
- প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ১৫-২০ মিনিট বই পড়ার রুটিন তৈরি করুন
- ছড়া, রূপকথা, প্রাণীর গল্প—বৈচিত্র্য রাখুন
- পড়ার সময় শিশুকে জিজ্ঞাসা করুন—”এরপর কী হবে মনে হয়?”
আমাদের দেশে ঠাকুরমার ঝুলি, সুকুমার রায়ের ছড়া, এবং আধুনিক শিশুসাহিত্যের প্রচুর সম্পদ আছে। এগুলো ব্যবহার করুন। বইমেলা থেকে বাচ্চাদের জন্য বই কিনুন।
২. খোলা খেলাধুলা—শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণা স্পষ্ট—শারীরিক কার্যকলাপ শুধু শরীরের জন্য নয়, মস্তিষ্কের জন্যও অত্যাবশ্যক। দৌড়ানো, লাফানো, খেলার সময় মস্তিষ্কে BDNF (Brain-Derived Neurotrophic Factor) নামক প্রোটিন তৈরি হয় যা নতুন নিউরন তৈরি করে এবং learning capacity বাড়ায়।
কী ধরনের খেলা:
- লুকোচুরি, দৌড়াদৌড়ি, গোল্লাছুট
- সাইকেল চালানো, দড়ি লাফ, বল খেলা
- পার্কে যাওয়া, গাছে চড়া (নিরাপদভাবে)
সুবিধা:
- মোটর স্কিল ডেভেলপমেন্ট
- সমস্যা সমাধান ক্ষমতা বৃদ্ধি
- সামাজিক দক্ষতা উন্নয়ন
- আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতা
ঢাকায় খেলার জায়গা কম। তবে ছাদে, বারান্দায় বা পাড়ার পার্কে অন্তত ১-২ ঘণ্টা বাচ্চাদের খেলতে দিন। সপ্তাহান্তে হাতিরঝিল, রমনা পার্ক, বা ধানমন্ডি লেকে নিয়ে যান।
৩. সৃজনশীল খেলা—কল্পনাশক্তি এবং সমস্যা সমাধান
হার্ভার্ডের ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজিস্টরা বলেন, “pretend play” বা ভান করে খেলা শিশুর cognitive development এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার-ডাক্তার খেলা, রান্নাঘর খেলা, দোকান-দোকান খেলা—এগুলো শুধু মজা নয়, এগুলো মস্তিষ্কের জিম।
কী দরকার:
- সাধারণ খেলনা (ব্লক, পুতুল, গাড়ি)
- ঘরের জিনিসপত্র (কার্ডবোর্ড বক্স, কাপড়, বালতি)
- কল্পনাশক্তি!
কেন কার্যকর:
শিশু যখন “আমি ডাক্তার” বলে খেলে, তখন সে:
- বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে চিন্তা করতে শিখছে (empathy)
- নতুন scenario তৈরি করছে (creativity)
- সমস্যা সমাধান করছে (problem solving)
- ভাষা এবং সামাজিক দক্ষতা অনুশীলন করছে
ইলেকট্রনিক খেলনা যা সব কিছু নিজে করে দেয়। শিশুকে নিজে চিন্তা করার সুযোগ দিন।
৪. পারিবারিক খাবারের সময়—ভাষা এবং সংযোগ
হার্ভার্ড রিসার্চ দেখায়, যেসব পরিবারে নিয়মিত একসাথে খাবার খাওয়ার অভ্যাস আছে, সেসব শিশুদের academic performance ভালো, মানসিক স্বাস্থ্য শক্তিশালী এবং সামাজিক দক্ষতা উন্নত।
কেন গুরুত্বপূর্ণ:
খাবারের টেবিলে কথোপকথন শিশুর জন্য ভাষা শেখার সেরা ক্লাস। পরিবারের সদস্যরা গল্প শেয়ার করেন, প্রশ্ন করেন, উত্তর দেন—এতে শিশু শেখে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয়।
কীভাবে করবেন:
- দিনে অন্তত এক বেলা সবাই একসাথে খান
- টিভি, মোবাইল বন্ধ রাখুন
- শিশুকে দিন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন—”আজ কী মজার হলো?”
- নিজের দিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন
- শিশুকে কথা বলার সুযোগ দিন, মাঝখানে কেটে দেবেন না
আমাদের দেশে পরিবার একসাথে খাওয়ার ঐতিহ্য আছে। এই সুন্দর অভ্যাস বজায় রাখুন এবং স্ক্রিন-মুক্ত রাখুন।
৫. প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো—সংবেদনশীল উদ্দীপনা
হার্ভার্ড টি.এইচ. চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের গবেষণা দেখায়, প্রকৃতিতে সময় কাটানো শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে, মনোযোগ বাড়ায় এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে।
কী করবেন:
- বাগানে খেলতে দিন, মাটি ধরতে দিন
- ফুল, পাতা, পোকামাকড় দেখান এবং নাম শেখান
- বৃষ্টিতে ভিজতে দিন (মাঝে মাঝে)
- পাখি দেখা, গাছ লাগানো—এসব কাজে সম্পৃক্ত করুন
সংবেদনশীল শিক্ষা:
প্রকৃতি শিশুর পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করে—দেখা, শোনা, স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ। এই multi-sensory experience মস্তিষ্কের সংযোগ শক্তিশালী করে।
গ্রামে থাকলে সহজ। শহরে থাকলে সপ্তাহান্তে বাইরে নিয়ে যান—বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, বা পার্ক।
৬. সংগীত এবং নৃত্য—মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ব্যায়াম
হার্ভার্ডের নিউরোসায়েন্স গবেষণা প্রমাণ করেছে, সংগীত মস্তিষ্কের প্রায় সব অংশ একসাথে সক্রিয় করে। এটি ভাষা, গণিত, spatial reasoning—সব কিছু উন্নত করে।
কীভাবে শুরু করবেন:
- ছড়া গান শোনান এবং একসাথে গান
- তাল দিয়ে হাততালি, নাচ
- সরল বাদ্যযন্ত্র দিন (ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম)
- বিভিন্ন ধরনের সংগীত শোনান—ক্লাসিক্যাল, লোকগীতি, রবীন্দ্র সংগীত
সুবিধা:
- মেমরি এবং মনোযোগ বৃদ্ধি
- ভাষা দক্ষতা উন্নয়ন
- আবেগিক প্রকাশ শেখা
- সমন্বয় এবং মোটর স্কিল
আমাদের দেশে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, পল্লীগীতি, বাউল গান—অসাধারণ সম্পদ। শিশুকে এই ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।
৭. হাতের কাজ এবং শিল্প—সূক্ষ্ম মোটর স্কিল এবং ধৈর্য
হার্ভার্ড এডুকেশন গবেষক বলেন, হাতের সূক্ষ্ম কাজ মস্তিষ্কের executive function উন্নত করে—যা পরিকল্পনা, মনোযোগ এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের জন্য দরকার।
কী কাজ:
- আঁকা, রঙ করা
- কাগজ কাটা, লাগানো
- মাটি দিয়ে কিছু তৈরি করা
- পুঁতি গাঁথা, সেলাই (বয়স অনুযায়ী)
- ব্লক দিয়ে ঘর বানানো
শেখায়:
- ধৈর্য এবং একাগ্রতা
- সৃজনশীল সমস্যা সমাধান
- আত্মবিশ্বাস (“আমি এটা তৈরি করেছি!”)
- Fine motor control (যা পরে লেখার জন্য দরকার)
কাগজ, রঙ পেন্সিল, আঠা—এগুলোই যথেষ্ট। দামি আর্ট সাপ্লাই লাগে না।
৮. পর্যাপ্ত ঘুম এবং রুটিন—মস্তিষ্কের বিশ্রাম এবং সংহতি
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের স্লিপ রিসার্চ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য তুলে ধরে—ঘুমের সময় মস্তিষ্ক দিনের শেখা তথ্য প্রসেস এবং সংরক্ষণ করে। পর্যাপ্ত ঘুম ছাড়া learning impossible
কতটুকু ঘুম দরকার:
- ১-২ বছর: ১১-১৪ ঘণ্টা (দিনের ঘুম সহ)
- ৩-৫ বছর: ১০-১৩ ঘণ্টা
- ৬-১২ বছর: ৯-১২ ঘণ্টা
কেন জরুরি:
- মেমরি consolidation
- মনোযোগ এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণ
- আবেগিক নিয়ন্ত্রণ
- শারীরিক বৃদ্ধি (growth hormone ঘুমে নিঃসৃত হয়)
ভালো ঘুমের রুটিন:
- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া
- ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে স্ক্রিন বন্ধ
- শোবার ঘর শান্ত, অন্ধকার এবং ঠান্ডা
- ঘুমানোর আগে বই পড়া, গান গাওয়া
কীভাবে শুরু করবেন:
সব একসাথে শুরু করতে হবে না। একটা করে শুরু করুন:
সপ্তাহ ১-২:
- ঘুমানোর আগে ১৫ মিনিট বই পড়া শুরু করুন
- খাবারের সময় ফোন দূরে রাখুন
সপ্তাহ ৩-৪:
- দিনে ১ ঘণ্টা বাইরে খেলার সময় নির্ধারণ করুন
- সপ্তাহান্তে প্রকৃতিতে যাওয়া
সপ্তাহ ৫-৬:
- সপ্তাহে ২-৩ দিন আর্ট/ক্রাফট টাইম
- গান শোনা এবং নাচ
চলমান:
সবগুলো অভ্যাস ধীরে ধীরে রুটিনের অংশ করুন।
বাবা-মায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
১. নিজে মডেল হন:
শিশু যা দেখে তাই শেখে। আপনি যদি সারাদিন ফোনে থাকেন, বাচ্চাও তাই চাইবে।
২. “না” বলতে শিখুন:
শিশু কান্নাকাটি করলেও ট্যাবলেট দেবেন না। ধৈর্য রাখুন।
৩. বিকল্প দিন:
“ফোন না” বললেই হবে না, বলুন “চলো একসাথে ব্লক দিয়ে খেলি।”
৪. পরিবার এবং বন্ধুদের বুঝান:
দাদা-দাদি, নানা-নানিকে বলুন ট্যাবলেট না দিতে।
স্ক্রিন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার কথা নয়—বরং শিশুর বয়স অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
হার্ভার্ড গবেষকদের ৮টি অভ্যাস কোনো ব্যয়বহুল বা জটিল কিছু নয়—এগুলোই শত বছর ধরে শিশুদের বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক উপাদান ছিল।
আপনার সময়, আপনার ভালোবাসা, এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাই শিশুর বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর সবচেয়ে বড় উপহার।

