একজন কিশোর, একটি অ্যাপ, আর হাজারো কণ্ঠস্বরের ন্যায়বিচার।
সকালবেলা যখন আমরা স্কুলে যাবার তাড়াহুড়িতে থাকতাম, তখন একজন কিশোর—মাগুরার সাদাত রহমান—চুপচাপ বসে ভাবছিলেন, কীভাবে সাইবার বুলিং বন্ধ করা যায়। তখন তার বয়স মাত্র ১৫। প্রযুক্তি বা সমাজসেবা—কোনোটাই তার পারিবারিক পেশা নয়। কিন্তু একটি ঘটনার ধাক্কা বদলে দিল সব।
এই লেখায় আমরা জানবো—কীভাবে সাদাত একজন সাধারণ ছাত্র থেকে হয়ে উঠলেন বিশ্বজয়ী একজন তরুণ যোদ্ধা। আর তার গল্প থেকে শেখা যাবে—আমরা কিভাবে নিজের সমস্যাকে সমাধানে পরিণত করতে পারি।
শুরুটা ছিল এক ট্র্যাজেডি থেকে
একজন সহপাঠী আত্মহত্যা করেছিল। কারণ? সে সামাজিক মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হয়েছিল। অনেকেই তখন চুপ থাকলেও সাদাত ভাবতে শুরু করলেন—“আমরা কেন কিছু করি না?”
ক্লাসের পরে বন্ধুরা যখন গেম খেলছিল, তখন সাদাত তার কম্পিউটার নিয়ে বসেছিলেন। নিজের সামান্য দক্ষতা আর প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে তৈরি করলেন Cyber Teens—একটি অ্যাপ, যেখানে বাংলাদেশের যে কেউ সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা গোপনে রিপোর্ট করতে পারে।
Cyber Teens অ্যাপ কী করে?
- কিশোর-কিশোরীদের জন্য নিরাপদ রিপোর্টিং সিস্টেম
- তথ্য গোপন রাখে, মানসিক সহায়তাও দেয়
- স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়
এই অ্যাপের মাধ্যমে মাগুরা অঞ্চলে অনেক তরুণ-তরুণী সাহস করে সামনে এসেছে, এবং প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০২০ সালে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে সাদাত রহমান পেলেন International Children’s Peace Prize—বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক শিশু অধিকার পুরস্কার, যা এর আগে মালালা ইউসুফজাই পেয়েছিলেন।
এই পুরস্কার পেয়ে তিনি বলেন:
“আমি শুধু মাগুরার একটা ছেলে। কিন্তু আমি চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি ছেলে-মেয়ে যেন নিজেদের জন্য দাঁড়াতে শেখে।”
কেন এই গল্পটা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
সাদাত কোনো ধনী পরিবারের সন্তান নন। তার কাছে ছিল না বড়ো কোনো টিম, বা বিদেশি প্রশিক্ষণ। কিন্তু ছিল একটা প্রশ্ন, একটা কষ্ট, আর একটা উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশের অনেক তরুণের মাঝেও এমন কিছু প্রশ্ন আছে:
- “আমার চারপাশে অনেক অন্যায় দেখি, আমি কী করতে পারি?”
- “আমার কোনো প্রভাব নেই, আমি কিছু পরিবর্তন করতে পারবো?”
- “আমার বয়স কম—কেউ তো শুনবেই না!”
এই গল্পটা মনে করিয়ে দেয়—বয়স নয়, আপনার চিন্তা আর আগ্রহই পারে সব বদলে দিতে।
আপনার জন্য ৫টি শিক্ষা সাদাতের গল্প থেকে
১. সমস্যা যেখানে, সমাধান সেখানেই
সাদাত খুব দূরে যাননি। নিজের স্কুল, নিজের শহর, নিজের পরিচিত মানুষের সমস্যাকে সমাধানে রূপ দিয়েছিলেন।
২. শুরু করলেই হয়
অনেকেই বলে, “এখনো সময় হয়নি।” কিন্তু পরিবর্তনের শুরু কখনো সময় দেখে আসে না। সাদাত নিজের অল্প জানা দিয়েই শুরু করেছিলেন।
৩. কমিউনিটি তৈরি করুন
বন্ধুদের নিয়ে মিলে কাজ করুন। আইডিয়া একার হতে পারে, বাস্তবায়ন হয় দল নিয়ে।
৪. আত্মবিশ্বাস রাখুন
প্রথম দিকে অনেকেই হাসবে। বলবে, “তুমি পারবে না।” কিন্তু একসময় তারাই বলবে, “তুমি কিভাবে পারলে?”
৫. প্রভাব ফেলতে চাইলে, এগিয়ে যান
আপনি না এগোলে কেউই এগোবে না। তাই, আপনি যদি অন্যরকম কিছু ভাবেন, তাহলে শুরুটা আপনাকেই করতে হবে।
গল্পটা এখানেই শেষ নয়…
আজ সাদাত একজন সোশ্যাল টেক ইনোভেটর হিসেবে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত তরুণদের নিয়ে কাজ করছেন নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার, ডিজিটাল নিরাপত্তা, ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে।
তিনি এখনো তার অ্যাপের পরবর্তী সংস্করণ বানাচ্ছেন, যাতে আরো বেশি জেলা ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হতে পারে।
আপনি কী শিখলেন?
এই গল্প পড়ার পর আপনার যদি মনে হয়—
- “আমার মধ্যেও কিছু করার ইচ্ছা আছে”
- “আমি এখনো শুরু করিনি, কিন্তু করতে চাই”
- “আমি জানি, আমার সমস্যার সমাধান আমি-ই দিতে পারি”
তাহলে আজই একটা খাতা খুলুন। লিখে ফেলুন—“আমি কী বদলাতে চাই?” তারপর একটু একটু করে পথ তৈরি করুন। সাফল্যের শুরু হয় একটা প্রশ্ন দিয়ে।
সাদাত প্রশ্ন করেছিলেন—“আমি যদি না দাঁড়াই, তাহলে কে দাঁড়াবে?”
আপনিও পারেন সেই প্রশ্ন থেকে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে।