যখন আমরা মালালা ইউসুফজাইয়ের নাম শুনি, তখন সাধারণত মনে আসে একজন সাহসী কিশোরী যে তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে নারী শিক্ষার অধিকারের জন্য। কিন্তু তার সাম্প্রতিক আত্মজীবনী ‘ফাইন্ডিং মাই ওয়ে’ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মালালাকে – একজন সাধারণ তরুণী যে প্রেমে পড়েছিল এবং সংগ্রাম করেছিল ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে।
যখন দুই পৃথিবী মিলিত হয়
২১ বছর বয়সে মালালার জীবনে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। একদিকে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ ছাত্রী হিসেবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন, অন্যদিকে বাড়িতে ফিরলেই হয়ে যেতেন পশতুন ঐতিহ্যের রক্ষাকারী এক কন্যা। এই দ্বৈত জীবন তার জন্য আরও জটিল হয়ে উঠেছিল যখন তার জীবনে প্রবেশ করেছিল পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা আসার মালিক।
মালালা নিজেই স্বীকার করেছেন যে পশতুন সংস্কৃতি অনুযায়ী বিয়ের আগে কোনো পুরুষের সাথে মেলামেশা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দেখা হলেও তা অবশ্যই পরিবারের উপস্থিতিতে হতে হবে। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই সব নিয়ম ভেঙে ফেলেছিলেন। এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “আমি চিৎকার করে বলতে চাইছিলাম, ‘তোমরা কেন বিয়ের চিন্তা করছ? ২১ বছরের অন্য কলেজ শিক্ষার্থীদের মতো আমি কি আমার জীবনযাপন করতে পারব না!'”
প্রথম পারিবারিক সাক্ষাৎ: একটি পরিকল্পিত নাটক
আসার মালিকের সাথে মালালার পরিবারের প্রথম পরিচয়ের দিনটি ছিল একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পিত অভিনয়। সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে ট্রেনে করে বার্মিংহামে পৌঁছানো, দুপুর ১২টায় লাঞ্চ এবং ঠিক দুপুর ১টায় লন্ডনে ফিরে যাওয়া – সবকিছুই ছিল মিনিট হিসেবে নির্ধারিত। মালালা ভেবেছিলেন, মাত্র এক ঘন্টায় খুব বেশি ভুল হওয়ার আশঙ্কা নেই।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। মালালার বাবা ভুলক্রমে সেদিন আরও সাতজন অতিথিকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বাগানে বারবিকিউ আর চায়ের আয়োজন চলছিল, আর গাছের নিচে চেয়ারে বসে সবাইকে, বিশেষ করে আসারকে, পর্যবেক্ষণ করছিলেন মালালার মা। তিনি আসারকে পশতু ভাষা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আসার সাহস দেখিয়ে কিছু বাক্য বলেছিল, যদিও মালালার মা বিশেষ মুগ্ধ হননি।
পুরো পরিস্থিতিটা মালালাকে ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তুলছিল। তিনি অনুভব করছিলেন যেন তার দুটি ভিন্ন পরিচয় একসাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। একদিকে তিনি মা-বাবার কাছে পূতপবিত্র পশতুন কন্যা, অন্যদিকে আসারের কাছে মজা করতে ভালোবাসা একজন প্রেমিকা।
চিকিৎসার দিনগুলো: শারীরিক ও মানসিক যুদ্ধ
আসারের সাথে পরিচয়ের পরদিনই মালালাকে বোস্টনে যেতে হয়েছিল জটিল একটি অস্ত্রোপচারের জন্য। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর ডা. টেসা হ্যাডলকের তত্ত্বাবধানে তার ‘ক্রস-ফেশিয়াল নার্ভ গ্রাফট’ নামের একটি জটিল অস্ত্রোপচার হবে, যা সফল হলে তার মুখের বাঁ দিক আরও সচল হবে।
এই অস্ত্রোপচার নিয়ে মালালার মনে দ্বিধা ছিল। তিনি জানতেন এর অর্থ পরপর তিনটি গ্রীষ্ম হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাটানো। কিন্তু তার মা-বাবা চেয়েছিলেন বার্মিংহামের হাসপাতালে প্রথমবার দেখা সেই ভয়ানক স্মৃতি – তলিয়ে যাওয়া চোখ, প্যারালাইজড মুখ – সেই স্মৃতি মুছে যাক। তারা চেয়েছিলেন আত্মীয়স্বজন ও অনলাইন ট্রলকারীদের থামাতে, যারা বলত, “গুলি চালানোর আগে তুমি কত সুন্দরই না ছিলে।”
বিমানে বসে আসারের কাছ থেকে একটি বার্তা এসেছিল, “তোমার মা-বাবা আমাদের সম্পর্কে কিছু কি বলেছেন?” মালালা সত্যিটাই জানিয়েছিলেন, “তাঁরা কিছুটা চিন্তিত।” তার মা-বাবা ভয়ে ছিলেন যে গোপনে কেউ তাদের ছবি তুলতে পারে বা বন্ধুদের মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যেতে পারে। কোনো একটি কেলেঙ্কারি ঘটার আগেই তারা চেয়েছিলেন মালালা যেন আসারের সাথে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করে দেয়।
ডরচেস্টার হোটেলে এক অবিস্মরণীয় সন্ধ্যা
অস্ত্রোপচার সফল হওয়ার পর লন্ডনে ফিরে মালালা আসারের সাথে দেখা করলেন। আসার লাহোরে ফিরে যাওয়ার আগে তারা ডরচেস্টার হোটেলের একটি ক্যান্টোনিজ রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেলেন। সার্জারির কারণে তখনও মালালার মুখ বেশ ফোলা ছিল, কিন্তু আসার তাকে দেখে সেই একই রকমভাবে হেসেছিল যেভাবে গ্রীষ্মের শুরুতে তাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল।
সেই রাতেই আসার মালালাকে তার মনের গভীর কথাগুলো বলেছিল। তিনি বলেছিলেন, “চলে গেলে তোমাকে অনেক মিস করব। সপ্তাহে একবারও তোমাকে না দেখলে অনেকটা শূন্য শূন্য লাগবে।” তারপর একটু থেমে আরও গভীর কথা বলেছিলেন, “সত্যি কথা বলতে, চাইলে কালই তোমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত, তবে সেই প্রস্তাব তোমাকে এখনই দেওয়াটা ঠিক মনে করছি না। কারণ, এটা তোমার ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হবে। তুমি এখনো অনেক ছোট।”
এই কথাগুলো শুনে মালালা কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি ভাবছ আমি ছোট বলে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারি না? তাহলে তুমি ২৯ বছর বয়সে এসে কীভাবে বুঝলে যে তুমি কাউকে ভালোবাসো?” আসার তখন বলেছিল যে সে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করেছিল। প্রশ্নগুলো ছিল এমন: “ওর সঙ্গে সময় কাটাতে কি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলাটা কি উপভোগ করি? ওকে কি বিশ্বাস করি?”
গোপনীয়তার যন্ত্রণা
আসার তার মনের কষ্টের কথাও বলেছিল সেই রাতে। তিনি বলেছিলেন, “কারও জীবনে ‘গোপন ব্যক্তি’ হয়ে থাকা ভালো লাগবে না, বিশেষ করে যখন আমি চাই সবাই জানুক তুমি কত অসাধারণ। আমি তোমাকে নিয়ে সমুদ্রসৈকতে ছুটি কাটাতে চাই, দুজনের ছবিতে ফোনের গ্যালারি ভরে ফেলতে চাই।” কিন্তু তিনি জানতেন না সেটা কবে হবে বা আদৌ হবে কি না।
মালালা বুঝিয়েছিলেন যে এই গোপনীয়তাটা আসলে তার মা-বাবাকে শান্ত রাখার জন্য। তারা ভয় পায় পাছে কোনো কেলেঙ্কারি না হয়ে যায়। কিন্তু আসার আরও গভীরে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি মনে করি তুমি এটা গোপন রাখছ, কারণ এখনো তুমি নিশ্চিত নও জীবনে কী চাও, আমার কাছ থেকেই-বা কী চাও। এটা ঠিক আছে!”
আসারের পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছিল তার এই কথায়: “জীবন পরিচালনায় কোনো দিকনির্দেশনার চিহ্ন থাকে না। কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত জীবন চালাতে পারে না, ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া বা হৃদয় ভাঙার আশঙ্কা সব সময় থেকেই যায়।”
একটি কঠিন সিদ্ধান্ত
এই গভীর আলোচনার পর মালালা একটি কঠিন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা কি সাময়িক বিরতি নিতে পারি? শুধু তত দিন, যত দিন আমি অক্সফোর্ড-অধ্যায় না শেষ করছি। তারপর আগামী জুনে এখান থেকেই আবার শুরু করব।” এই প্রস্তাবে প্রকাশ পেয়েছিল মালালার একাডেমিক ক্যারিয়ারের প্রতি গুরুত্ব এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা।
আসার হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার মনে হয় না, অনুভূতিগুলোকে এভাবে ‘পজ’ করে রাখা যায়। তবু তোমার জন্য আমি চেষ্টা করব।” এই উত্তরে প্রকাশ পেয়েছিল তার ভালোবাসার গভীরতা এবং মালালার সিদ্ধান্তকে সম্মান করার মানসিকতা।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি” – শেষ বিদায়
হোটেল লবির এক কোণে অল্প আলোয় এসে বিদায় বলার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন তারা। আসার যখন আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলেন, মালালা ফিসফিস করে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” এই কথাগুলোতে লুকিয়ে ছিল একজন তরুণীর সমগ্র হৃদয়ের আবেগ – যে একইসাথে সংগ্রাম করছিল ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে, ভালোবাসা ও দায়িত্বের মধ্যে।
একটি সার্বজনীন গল্প
মালালা ইউসুফজাইয়ের প্রেমের গল্প শুধু তার একক অভিজ্ঞতা নয়, এটি আধুনিক যুগের অসংখ্য তরুণ-তরুণীর সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। যারা প্রতিদিন লড়াই করে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে, পারিবারিক প্রত্যাশা ও ব্যক্তিগত পছন্দের মধ্যে, ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে।
মালালার অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে ভালোবাসা একটি জটিল আবেগ, যেখানে প্রয়োজন পারস্পরিক বোঝাপড়া, ধৈর্য ও পরিপক্বতা। এটি দেখায় যে একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বও মূলত একজন সাধারণ মানুষ, যার হৃদয়ে রয়েছে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা এবং জীবনের সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সংগ্রাম।
এই গল্প প্রমাণ করে যে, প্রেম ও সম্পর্ক সময়ের সাথে বিকশিত হয় এবং কখনও কখনও অপেক্ষা ও ধৈর্যই সবচেয়ে বড় ভালোবাসার প্রমাণ হতে পারে। ২০২১ সালে মালালা ও আসারের বিয়ে এই কথারই সাক্ষ্য বহন করে।