দুপুরবেলা হুট করে একটা চাকরির ইন্টারভিউ মেইল যখন এসেছিল, ইশরাত খুব খুশি হয়েছিল। পরদিন দশটায় পরিপাটি জামা পরে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে পেল প্রথম বিপত্তি। দুইটা মাত্র পোস্টের জন্য অপেক্ষা করছে ৩৫জন! মনোবল দূর্বল হয়ে গেল তখন থেকেই। এরপর তার ডাক যখন এলো, রুমে চেয়ারে পাশাপাশি বসা গম্ভীর চেহারার মানুষগুলোকে দেখে সে এতই ।ঘাবড়ে গেল, যে তারা যতই সহজ হতে বলে, ইশরাত তা আর কিছুতেই পারে না।সহজ প্রশ্নের উত্তরও তার মনে পরছে ন। ফলে, যে চাকরিটা সহজেই তার হতে পারত, সেটা না পাবার আফসোস নিয়ে ফিরতে হল বাসায়।
ইন্টারভিউ নিয়ে এই অভিজ্ঞতা আছে ইশরাতের মত হাজার হাজার মানুষের, বিশেষ করে নতুনদের। প্রতিষ্ঠান ছোট হোক বা বড় যে কোন চাকরির জন্য ইন্টারভিউ একটি বড় বিষয়। ইন্টারভিউ বোর্ড বা প্যানেলের সামনে মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য যেমন কারো ক্যারিয়ার গড়ে দিতে পারে, আবার শেষও করে দিতে পারে। তাই আপনার চাকরি পাবার সম্ভাবনা অনেকখানি নির্ভর করে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে ইন্টারভিউ দিতে পেরেছেন তার উপর। কিন্তু ইন্টারভিউতে বাজিমাত করার মূলমন্ত্রটা কি?আসুন তাহলে জেনে নেয়া যাক সেই মূলমন্ত্র।
১। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানাঃ
যে প্রতিষ্ঠানে আপনি কাজ করতে চাইছেন সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। । প্রযুক্তির এই যুগে যে কোনো কোম্পানির ওয়েবসাইটে গেলেই পেয়ে যাবেন যেকোনো তথ্য।অথবা সেখানে কাজ করেছে, এমন পরিচিতজন থাকলে তাদের সাহায্যও নিতে পারেন। মোটকথা, যেভাবেই হোক কোম্পানির সাধারণ সব তথ্য যেন আপনার নখদর্পনে থাকে। ভাইবা বোর্ডের সদস্যরা যখন দেখবে তাদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আপনার ধারণা এত স্বচ্ছ, তারা বুঝতে পারবে আপনি চাকরিটি কত গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন।
২। যে পোস্টের জন্য যাচ্ছেন, সেটার ব্যাপারে পূর্ণজ্ঞান রাখবেনঃ
এটা একটা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। আপনার আবেদন করতে যাওয়া পোস্টটি সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে কখনওই যাবেন না। অনেকসময় এই ভুল করার কারনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তাছাড়া আপনার দায়িত্বগুলো জেনে নিয়েই ইন্টারভিউ বোর্ডে সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর তৈরি করে রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির বেছে দেওয়া দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্য থেকে কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলো আপনার আছে অথবা নেই সবকিছু মাথায় রেখেই দিতে হবে উত্তর।
৩। আপনার ‘সেলিং পয়েন্ট’ নিয়ে নিঃসন্দেহ থাকবেনঃ
সেলিং পয়েন্ট হল আপনার এমন একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য যার কারনে ইন্টারভিউ বোর্ড আপনাকে পছন্দ বা বাছাই করতে বাধ্য হবে। সবার সেলিং পয়েন্ট একরকম না। কেউ হয়ত অনেক বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, কেউ আবার খুব ভাল রেজাল্ট নিয়ে এসেছে। কাজেই আপনাকে আগে ওই পোস্টটির জন্য নিজের সেলিং পয়েন্ট সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এবং ইন্টারভিউ শুরুর পর একদম প্রথম পাঁচমিনিটের মধ্যেই জুড়িবোর্ডকে বিষয়টি জানিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।
এক্ষেত্রে আগে থেকেই নিজের সব যোগ্যতা এবং বিশেষ গুণাবলীর একটি লিস্ট করে ফেলতে পারেন। এরপর আপনার অ্যাপ্লাই করা পোস্টটিতে যেসব আবশ্যক গুণাবলী প্রয়োজন, সেটার সাথে নিজের গুণগুলো মিলিয়ে দেখতে পারেন। এই দুইয়ের সমন্বয় করলেই খুঁজে পাবেন আপনার বিশেষ সেলিং পয়েন্টগুলো।
৪। কমন ইন্টারভিউ প্রশ্ন-উত্তর ভালোভাবে জেনে যাবেনঃ
গুগলে কমন ইন্টারভিউ প্রশ্নউত্তর খুব সহজেই পাওয়া যায়। আপনার পছন্দমত বাছাই করে একটা লিস্ট করে ফেলুন। তারপর উত্তরগুলো সুন্দরভাবে বলা প্রাকটিস করুন। অনেকেই এই কাজটা করে না এটা ভেবে যে, সহজ উত্তর যেকোন সময় প্রস্তুতি ছাড়াই দেওয়া যায়। অথচ উত্তর গুছিয়ে বলা প্রাকটিস করলে যেকোন নার্ভাস অবস্থাতেও আপনি আমতা আমতা করবেন না। সেই সাথে জুড়ি বোর্ডের কাছে আপনার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। আর, এরমধ্যেই আপনার এক্সপেক্টেড স্যালারি নির্ধারণ করতে ভুলবেন না। এই কাজটির সুফল একবার করলেই বুঝতে পারবেন।
৫। আপনার দূর্বলতার কথা মাথায় রেখে উত্তর সাজাবেনঃ
একদম পারফেক্ট হওয়া তো সম্ভব না। কিছু দুর্বলতা থাকবেই। আপনি যদি আগেই জেনে যান, এই পোস্টে কাজ করতে আপনার সম্ভাব্য দুর্বল দিকগুলো কি কি, তাহলে সে ব্যাপারে জুড়ি বোর্ডের কঠিন প্রশ্ন থেকে নিজেকে রক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। চাইলে কোনো সুন্দর উত্তর তৈরি করতে পারেন, অথবা কথার মোড় ঘুরিয়ে নেবার বুদ্ধিও বের করতে পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন, কখনোই যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়তে হয় যে আপনার পক্ষ থেকে চুপ থাকা ছাড়া উপায় নেই! উপস্থিতবুদ্ধি, কৌশল ও দক্ষতা দিয়ে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করতে হবে।
৬। বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দেবার মনোভাব রাখতে হবেঃ
জুড়ি বোর্ডে অনেকসময়ই পড়তে হয় বিব্রতকর অবস্থায়। অনেকেই বিশেষ গোষ্ঠী বা জাতিবিদ্বেষী, বর্ণবাদী মন্তব্য করেন। এধরনের পরিস্থিতিতে পড়ার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে পদক্ষেপ নেয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে যদি কোনো অন্যায় কিছু আপনার সাথে করা হয় বা কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপারে আক্রমণ করে কথা বলা হয়, তাহলে সেখান থেকে অবস্থা বুঝে প্রতিবাদ করে চলে আসতেও পিছপা হবেন না। সব অবস্থাতেই নিজের আত্মসন্মানবোধ অটল থাকতে হবে।
৭। আত্মবিশ্বাসই এনে দেবে সাফল্যঃ
আত্মবিশ্বাসী মানুষ কে না পছন্দ করে। নিজেকে তুলে ধরতে আত্মবিশ্বাসের কোন বিকল্প নেই। আর এই আত্মবিশ্বাস তখনি আসবে, যখন আপনি নিজে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবেন, সত্যিই আপনি কাজটির জন্য উপযুক্ত। অনেকে আত্মবিশ্বাসের সাথে দাম্ভিকতাকে মিলিয়ে ফেলে সমস্যায় পড়ে যায়। আপনার কথা শুনে যেন কোনভাবেই মনে না হয় যে আপনি নিজেকে নিয়ে অহংকার করে কিছু বলছেন। বরং আপনি যে সত্যি যোগ্য তা খুব স্পষ্টভাবে কিন্তু নম্রসুরে বলুন। আপনার সব আচরনেই যেন এই আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে।
৮। হাসিমুখে কথা শেষ করুনঃ
কথায় আছে “সব ভাল তার, শেষ ভাল যার।“
খুব ভালো একটা ইন্টারভিউ যদি শেষ হয় অসমাপ্ত ভাবে, তাহলে পুরোটাই পণ্ডশ্রম! কথা শেষ করুন হাসিমুখে। মনে রাখবেন, আপনার সেলিং পয়েন্ট পরিষ্কারভাবে না বুঝিয়ে চলে আসবেন না। আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাবেন। যেন, আপনি বের হয়ে যাবার পর জুড়ি বোর্ডের মনে হয়, খুব ভাল একটি ইন্টারভিউ শেষ হয়েছে।
এছাড়া ছোট কিছু ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। যেমনঃ
১। পরিপাটি পোষাক পরতেই হবে। এতে শুধু দেখতে ভালো লাগবে তাই না, আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। যেই কোম্পানিতে ইন্টারভিউ, তাদের বিশেষ কোন বিধিনিষেধ আছে কিনা, সেটাও জেনে নিতে হবে।
২। সমৃদ্ধ একটি সিভি অবশ্যই তৈরি করতে হবে। ইন্টারভিউ বোর্ডে সাধারণত সিভি দেখেই প্রশ্ন করে। কাজেই সেখানে যেন কোনোভাবেই বানানের ছোট বড় কোন ভুল না থাকে। তাছাড়া, খামে ভরে সিভির একটি হার্ডকপি নিতেও ভুলবেন না।
সবশেষে মনে রাখবেন, ইন্টারভিউ খারাপ কিনবা ভাল, যাই হোক না কেন, প্রতিবারই আপনি নতুন কিছু শিখবেন। যেটা আপনাকে প্রস্তুত করবে পরের যুদ্ধের জন্য। তাই, ঘাবড়ে না গিয়ে, আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করুন। সাফল্য আসবেই।
আরও পড়ুনঃ নিজের উপর আস্থা রাখুন: আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ১২টি কার্যকর উপায়