back to top
শুক্রবার, অক্টোবর ১০, ২০২৫
HomeLifestyleHealthy Livingকাজের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: হৃদয় ও মস্তিষ্ক থাকবে সুস্থ ও শক্তিশালী

কাজের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: হৃদয় ও মস্তিষ্ক থাকবে সুস্থ ও শক্তিশালী

প্রতিদিন সকালে অফিসের পথে যানজট, মিটিংয়ের চাপা ডেডলাইন, ক্লায়েন্ট কল, টার্গেটের বোঝা—সব মিলিয়ে কাজের চাপ যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী। বাইরে থেকে আমরা ঠিকঠাক দেখাই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চাপ নীরবে ক্ষতি করে আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্ককে। আপনি হয়তো ভাবছেন, কাজ তো করতেই হবে, চাপ কীভাবে এড়ানো যায়? সুখবর হলো, চাপ পুরোপুরি এড়ানোর দরকার নেই; বরং কিছু সহজ কৌশল মেনে চললেই এই চাপকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কাজের সঙ্গে তাল মিলিয়েই রাখা যায় সুস্থ হৃদয়, শান্ত মস্তিষ্ক আর ইতিবাচক জীবন।

আসুন, স্পাইকস্টোরিতে আজ আমরা সেই কৌশলগুলো নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনার বাংলাদেশি কর্মজীবনের বাস্তবতার সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিতে পারবে। এই গল্পগুলো আপনারই হতে পারে, আপনার পাশের কোনো সহকর্মীরও হতে পারে।

নীরব ক্ষয়: কেন সতর্ক হওয়া জরুরি

রুবেল সাহেব একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। গত কয়েক মাস ধরে তার নতুন ম্যানেজার অসম্ভব টার্গেট চাপিয়ে দিয়েছেন। রাত ১০টায়ও অফিস থেকে বের হওয়া দায়। কিছুদিন ধরে তিনি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিলেন না। সকালে উঠেই বুকে ধড়ফড়, মাথা ভার লাগত। অফিসে কাজে মনোযোগ দিতে পারতেন না, ছোটখাটো বিষয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে লেগে যেত ঝগড়া।

একদিন মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন। ডাক্তার দেখলেন, কোনো বড় শারীরিক রোগ নেই, কিন্তু স্ট্রেসের মাত্রা মারাত্মক বেশি। ডাক্তার বললেন, “রুবেল সাহেব, রোগ নেই, কিন্তু এই স্ট্রেসই ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাকের বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।” রুবেলের এই গল্পটা আমাদের চারপাশের বাস্তবতাই তুলে ধরে।

দীর্ঘদিনের কাজের চাপ শরীরে কর্টিসলসহ স্ট্রেস হরমোন বাড়ায়। অল্প সময়ের জন্য এটা সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর ফল মারাত্মক:

  • হৃদয়ে চাপ তৈরি হয়: কর্টিসল রক্তনালীকে সংকুচিত করে, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এতে হার্টের ওপর ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
  • মস্তিষ্কে চাপ পড়ে: স্ট্রেস হরমোন মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তির কেন্দ্র হিপোক্যাম্পাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে মনোযোগ কমে, ভুলে যাওয়া, উদ্বেগ (Anxiety) তৈরি হয়।
  • ক্লান্তি ও মেজাজের সমস্যা: চাপ থেকে সৃষ্ট ইনসোমনিয়া (Insomnia) বা ঘুমের সমস্যা এবং এর ফলস্বরূপ খিটখিটে মেজাজ দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

অর্থাৎ চাপ সবসময় উচ্চস্বরে প্রকাশ পায় না—এটা নীরবে আমাদের ক্ষয় করতে থাকে।

চাপ নিয়ন্ত্রণের ইতিবাচক কৌশল

আমাদের দেশের কর্মজীবনের বাস্তবতা—ঢাকার যানজট, কর্পোরেট অফিসে ১০-১২ ঘণ্টার কাজ, গার্মেন্টস ফ্লোরের শিফট—সবকিছুই কঠিন। তাই আমাদের এমন কিছু কৌশল জানতে হবে, যা কাজের মধ্যে থেকেই সহজে মানা সম্ভব।

১) ছোট বিরতিতে কাজের রিদম ঠিক করুন

একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলে মস্তিষ্ক ও শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে কাজের দক্ষতা কমে যায় এবং চাপ বাড়ে। এই সমস্যা এড়াতে বিখ্যাত পোমোডোরো টেকনিকের মতো একটি পদ্ধতি অনুসরণ করুন:

  • ৫০ মিনিট কাজ + ১০ মিনিট হাঁটা/স্ট্রেচ
  • অথবা, ২৫ মিনিট কাজ + ৫ মিনিট বিরতি

এই ছোট বিরতিতে উঠে দাঁড়ান, ডেস্কে বসে একটু শরীর টান টান করুন (স্ট্রেচিং), অথবা করিডোরে একটু হেঁটে আসুন। এতে রক্তসঞ্চালন বাড়ে, মস্তিষ্ক অক্সিজেনের জোগান পায় এবং আপনি সতেজভাবে কাজ শুরু করতে পারেন। প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে, চাপ কমবে।

২) শ্বাসের জাদু – ৪-৭-৮ টেকনিক

যখনই অনুভব করবেন চাপ বাড়ছে বা বুক ধড়ফড় করছে, তখনই চেয়ারে বসেই এই সহজ শ্বাসের অনুশীলনটি করুন। একে বলে ৪-৭-৮ টেকনিক (৪-৭-৮ Breathing Technique)।

  • ৪ সেকেন্ডে শ্বাস নিন (পেট ফুলিয়ে)
  • ৭ সেকেন্ড ধরে রাখুন (দম বন্ধ করে)
  • ৮ সেকেন্ডে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন (মুখ দিয়ে)

দিনে কয়েকবার এই অনুশীলন করলে তা সরাসরি প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে সক্রিয় করে। এর ফলে হার্টরেট কমে, শরীর শান্ত হয় এবং তাৎক্ষণিক উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে আসে।

৩) ডিজিটাল সীমা (Digital Boundaries)

অফিসের ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশনগুলো ক্রমাগত আপনার মনোযোগ নষ্ট করে এবং স্ট্রেস বাড়ায়। সব নোটিফিকেশনের জবাব একসাথে দিতে হবে না। একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন (যেমন—সকাল ১১টা, বিকেল ৪টা) যখন আপনি কেবল ইমেইল ও মেসেজ চেক করবেন।

  • অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন।
  • অফিসের সময় শেষে ইমেইল অ্যাপ বন্ধ করে দিন।
  • জরুরি না হলে ছুটির দিনে অফিসিয়াল ফোন/ল্যাপটপ ধরবেন না।

এতে অপ্রয়োজনীয় স্ট্রেস কমবে এবং আপনি ব্যক্তিগত জীবনে সময় দিতে পারবেন।

৪) স্বাস্থ্যকর খাবার অফিস-রেডি

আমাদের এনার্জি এবং মনোযোগ ধরে রাখার জন্য সঠিক খাবার অপরিহার্য। কাজের চাপে না খেয়ে থাকা বা অস্বাস্থ্যকর জাঙ্ক ফুড খাওয়া এনার্জিকে কমিয়ে দেয় এবং মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়।

  • সকালের নাস্তা: ডিম/ওটস/চিড়া-দই – যা দীর্ঘ সময় শক্তি দেবে।
  • দুপুর: ভাত/রুটি + ডাল + মাছ/মুরগি/ডিম + পর্যাপ্ত সবজি – ভারি খাবারে ঘুম এড়াতে পরিমাণ সীমিত রাখুন।
  • স্ন্যাকস: কাজুবাদাম/পেস্তা/ফল (যেমন কলা/আপেল)/চানা – এসব ব্রেন ফুড হিসেবে কাজ করে।
  • কফি সীমিত রাখুন (দিনে ১-২ কাপ), পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করুন।

খাবারের রুটিনই আপনার শক্তি ধরে রাখে, মনকেও করে ফোকাসড।

৫) হাঁটা আর নড়াচড়া: হৃদয় থাকবে অ্যাক্টিভ

ডেস্কে বসে কাজ করলে শরীর স্থবির হয়ে যায়। কিন্তু হৃদয়কে সুস্থ রাখতে এবং চাপ কমাতে নড়াচড়ার বিকল্প নেই।

  • প্রতি ঘণ্টায় ১০০ ধাপ হাঁটা: পানি পান বা বাথরুমে যাওয়ার জন্য একটু হেঁটে আসুন।
  • লিফট বাদ দিয়ে সিঁড়ি ব্যবহার: এটি আপনার হার্টের জন্য ছোটখাটো কার্ডিও ব্যায়াম।
  • ডেস্কে ছোটখাটো স্ট্রেচিং: মাথা ঘোরানো, কাঁধ উপরে-নিচে করা—এগুলো ঘাড় ও কাঁধের পেশীর চাপ কমায়।

নিয়মিত নড়াচড়া রক্তে এন্ডোরফিন (Feel-good hormone) নিঃসরণ করে, যা আপনার মনকে ভালো রাখে।

৬) ঘুমকে প্রজেক্ট বানান

ঘুমকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে চলবে না। এটি আপনার মস্তিষ্ক ও হার্টের জন্য একটি মেরামত প্রক্রিয়া

  • একই সময়ে শোয়া-উঠা: এটি আপনার দেহের সার্কাডিয়ান রিদম ঠিক রাখে।
  • রাতে স্ক্রিন কমানো: ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভি দেখা বন্ধ করুন।
  • শোবার ঘর ঠান্ডা ও অন্ধকার রাখুন।

ভালো ঘুম হলে স্ট্রেস হরমোন কমে, স্মৃতিশক্তি বাড়ে এবং চাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।

৭) কথা বলুন, একা লড়বেন না

অতিরিক্ত কাজ নিয়ে একা লড়তে যাবেন না। প্রয়োজনে ভদ্রভাবে “না” বলতে শিখুন। বসের বা সহকর্মীর কাছে কাজের চাপ কমানোর জন্য যুক্তি সহকারে অনুরোধ করুন। যেমন:

“এই সপ্তাহে হাতে থাকা কাজ শেষ না হলে নতুনটা নিলে ডেডলাইন রিস্ক হবে; আমরা কি পরের সপ্তাহে নিতে পারি?”

টিমে কাজ ভাগাভাগি করুন। আপনার মনের কথা বিশ্বাসী কারও সাথে শেয়ার করুন। চাপ হালকা হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ হিসেবে পজিটিভ অভ্যাস

  • ছোট ছোট জয়ের তালিকা লিখুন (Tiny Triumph): দিনের শেষে ডায়েরিতে লিখুন: “আজ সকালের হাঁটা হলো”, “একটা কঠিন মেইল শেষ করলাম” বা “নতুন ক্লায়েন্টকে ম্যানেজ করলাম”—এতে মস্তিষ্ক ডোপামিন পায়, যা আপনার আত্মবিশ্বাস ও মন ভালো রাখে।
  • মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন করুন: রিকশায় বসে বা মেট্রোতে যাত্রার সময় ২ মিনিট কেবল আপনার শ্বাস গোনা বা বাইরের শব্দে মনোযোগ দেওয়াও মাইন্ডফুলনেস। এটি আপনার মস্তিষ্ককে বর্তমান মুহূর্তে ফিরিয়ে আনে।

কাজের চাপ পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এটি আপনার হৃদয় বা মস্তিষ্ককে ক্ষয় করার আগেই আপনাকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ছোট ছোট অভ্যাস, সঠিক রুটিন আর ইতিবাচক মানসিকতা আপনাকে দেবে সুস্থ হৃদয়, শান্ত মস্তিষ্ক আর ভারসাম্যপূর্ণ জীবন

বছরে একবার অন্তত রক্তচাপ, শর্করা, কোলেস্টেরল টেস্ট করান। যদি দেখেন উদ্বেগ বা হতাশা আপনাকে গ্রাস করছে, দ্বিধা না করে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কারণ, সুস্থ আপনি মানেই সফল আপনি। আজ থেকেই শুরু হোক ছোট্ট পরিবর্তন

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular