“তোমাকে দেখে বোঝাই যায় না যে বয়স ৪০ পেরিয়েছে!”
এই একটা প্রশংসা শুনতে চাই না এমন মানুষ খুব কমই আছে।
সুন্দর ও টানটান চামড়া, মুখে একটাও বলিরেখা নেই, ঝলমলে ত্বক—এই সৌন্দর্যের খোঁজে আজকাল অনেকেই ছুটছেন ‘অ্যান্টি-এজিং’ ট্রিটমেন্টের দিকে।
বোটক্স, স্কিন ফিলার, কেমিক্যাল পিল, বা অ্যান্টি-এজিং সাপ্লিমেন্ট—যা-ই হোক না কেন, সবার লক্ষ্য একটাই: বয়স লুকানো।
কিন্তু এই বয়স লুকানোর চেষ্টাই কখনো কখনো এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না।
চেহারার জন্য শরীর, শরীরের জন্য মন—এই জায়গাগুলো কি আমরা ভুলে যাচ্ছি?
কেন মানুষ অ্যান্টি-এজিং ট্রিটমেন্ট নেয়?
১. চেহারায় বয়সের ছাপ কমাতে
বয়স বাড়লে আমাদের ত্বকের কোলাজেন কমে যায়, elasticity নষ্ট হয়। ফলে মুখে রিংকেল, ডার্ক স্পট, ফাইন লাইন দেখা যায়।
এইগুলো কমানোর জন্য নেয়া হয়:
- বোটক্স ইনজেকশন
- ডার্মাল ফিলার
- কেমিক্যাল পিল
- স্কিন লেজার ট্রিটমেন্ট
২. সেলফ-ইমেজ বা আত্মবিশ্বাস বাড়াতে
আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে “কেমন দেখাচ্ছে?”—এই প্রশ্নটা সবসময় মাথায় ঘোরে।
অনেকে বলেন, “আমি তো শুধু নিজের জন্য করছি, যেন আয়নায় তাকালে ভালো লাগে।”
এই আত্মবিশ্বাসের খোঁজে অনেকেই ছুটছেন চিরযৌবনের পেছনে।
৩. পেশাগত চাপ থেকে
বেশ কিছু পেশায়, যেমন—মিডিয়া, কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং, বা কনসালটিং—“ফার্স্ট ইম্প্রেশন” একটা বড় বিষয়। অনেকে মনে করেন, তরুণ দেখালেই ক্লায়েন্ট বা বসের আস্থা বাড়ে।
এ কারণেও কেউ কেউ অ্যান্টি-এজিং প্রোডাক্ট বা ট্রিটমেন্টের পথে হাঁটেন।
কিন্তু সমস্যা হয় যখন…
এতসব চাহিদার মাঝে একটাই সমস্যা—সব ট্রিটমেন্ট বা প্রসেস নিরাপদ নয়।
সাধারণ সাইড ইফেক্ট:
- ত্বকে জ্বালাপোড়া
- লালচে হয়ে যাওয়া বা ফোলাভাব
- ত্বকের স্বাভাবিক রঙ বদলে যাওয়া
- ব্রণ বা ইনফেকশন হওয়া
- এলার্জিক রিঅ্যাকশন
গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- বোটক্স ইনজেকশনের ভুল প্রয়োগে পেশি দুর্বল হয়ে পড়া
- ভুল জায়গায় ফিলার দিলে মুখের কাঠামো বিকৃত হওয়া
- কেমিক্যাল পিলে স্কিন বার্ন বা স্থায়ী ক্ষত
- স্টেরয়েড ক্রিমে ত্বকের স্থায়ী পাতলা হয়ে যাওয়া
- অ্যান্টি-এজিং সাপ্লিমেন্টে লিভার/কিডনির ক্ষতি
একটি বাস্তব গল্প:
ঢাকার উত্তরা এলাকার নাজমা আপা (৩৮), ইউটিউব দেখে নিজের চেহারায় ফিলার প্রয়োগ করান স্থানীয় বিউটি পার্লারে।
কিন্তু কয়েকদিন পর মুখে ফুলে ওঠা, ব্যথা, আর মুখ বিকৃত হয়ে যায়। পরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে জানতে পারেন—ফিলার ছিলো নকল এবং ইনজেকশন দেয়ার পদ্ধতিও ছিলো ভুল।
কেন এই ট্রিটমেন্টগুলো কখনও ‘ডেঞ্জারাস’ হতে পারে?
১. অযোগ্য বা প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তির হাতে চিকিৎসা
বাংলাদেশে অনেক বিউটি সেলুন বা ক্লিনিকে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে যাদের মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ডই নেই।
২. নকল ও অননুমোদিত প্রোডাক্ট ব্যবহার
অনেকসময় বিদেশি নামী ব্র্যান্ডের নামে চীন বা লোকাল নকল পণ্য ব্যবহার করা হয়—যার কার্যকারিতা নেই বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়াবহ।
৩. ডাক্তার বা স্কিন এক্সপার্টের পরামর্শ ছাড়া সাপ্লিমেন্ট খাওয়া
কিছু “Anti-Aging” ক্যাপসুল বা হরমোন বুস্টার দীর্ঘমেয়াদে লিভার, কিডনি এমনকি হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
৪. “অতিরিক্ত ভালো দেখাতে হবে” মনোভাব
যখন কেউ বারবার একই ইনজেকশন বা প্রসেস নিচ্ছেন শুধুই ‘আরও তরুণ’ দেখানোর জন্য—সেটা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।
কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখবেন?
১. কোনো ট্রিটমেন্ট নেয়ার আগে ভালো করে জানুন
YouTube রিভিউ নয়, স্কিন স্পেশালিস্ট বা ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নিন।
২. ক্লিনিক বা বিউটি সেন্টারের লাইসেন্স দেখুন
যেখানে যাচ্ছেন, তারা কীভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন, সেই বিষয়টা যাচাই করুন।
৩. নিজের স্কিন টাইপ জানুন
সব ত্বক সব ট্রিটমেন্টে সাড়া দেয় না। আপনার স্কিন কি সেনসিটিভ, ড্রাই, বা অয়েলি—তা অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট নিন।
৪. প্রাকৃতিকভাবে যত্ন নিন
প্রতিদিন সানস্ক্রিন, হাইড্রেশন, স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম—এইগুলোই আপনাকে ভিতর থেকে ইয়ং রাখবে।
আপনি যেমন, তাই সুন্দর
অ্যান্টি-এজিং ট্রিটমেন্টের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের প্রতি ভালোবাসা, যত্ন ও আত্মবিশ্বাস।
বয়সের ছাপ মানেই আপনি কম সুন্দর নন। বরং অভিজ্ঞতা, পরিণত চিন্তা, আর নিজের যত্ন নেওয়ার অভ্যাস আপনাকে আরও আলোকিত করে তোলে।
বয়স হবে, ত্বকে রেখা পড়বে, চুলে রঙ আসবে—এটাই জীবন।
তবে আপনি যদি নিজের যত্ন নিতে জানেন, অভ্যাস ঠিক রাখেন, এবং নিজের ভেতরের সৌন্দর্য লালন করেন—তাহলে কোনো ইনজেকশন বা কেমিক্যালের প্রয়োজন হবে না।
সুন্দর থাকুন, তবে বুদ্ধি নিয়ে।
নিজেকে ভালোবাসুন, তবে বিজ্ঞভাবে।
যা করতে যাচ্ছেন, তা সম্পর্কে জানুন—তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
চিরযৌবনের খোঁজে যেন না হারাই আমাদের প্রকৃত সৌন্দর্য—ভেতরের প্রশান্তি।