back to top
বুধবার, ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫
HomeWellbeingখালি পায়ে হাঁটুন, সুস্থ থাকুন—আর্থিংয়ের সত্যিকারের উপকারিতা জানুন!

খালি পায়ে হাঁটুন, সুস্থ থাকুন—আর্থিংয়ের সত্যিকারের উপকারিতা জানুন!

স্ট্রেস, অনিদ্রা, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, উদ্বেগ—এসব আধুনিক জীবনের সাধারণ সমস্যা। আমরা ওষুধ খাই, থেরাপি নিই, কিন্তু সমস্যা থেকেই যায়।

কিন্তু সমাধান আপনার পায়ের নিচেই আছে! মাটির সাথে সরাসরি সংযোগ—এই একটি সহজ কাজ যা আপনার শরীর এবং মনে বিস্ময়কর পরিবর্তন আনতে পারে।

হাজার বছর ধরে প্রাচীন সংস্কৃতিগুলো জানত যে পৃথিবী নিরাময় করে। এখন আধুনিক বিজ্ঞান সেই একই কথা বলছে। গবেষণা প্রমাণ করছে, খালি পায়ে প্রাকৃতিক মাটিতে হাঁটলে শরীর পৃথিবীর সূক্ষ্ম তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি শোষণ করে, যা শক্তিশালী শারীরিক এবং মানসিক উপকার দেয়।

একে বলে “আর্থিং” বা “গ্রাউন্ডিং”।

আজকে জানবো আর্থিং কীভাবে কাজ করে, কী কী উপকার দেয় এবং আপনি কীভাবে এটা আপনার জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন।

আর্থিং বা গ্রাউন্ডিং আসলে কী?

খুব সহজ করে বললে, খালি পায়ে প্রাকৃতিক জমিনে (ঘাস, মাটি, বালি, এমনকি কংক্রিট) দাঁড়ানো বা হাঁটাকেই বলে আর্থিং।

কিন্তু এর পেছনে আছে বিজ্ঞান। পৃথিবীর পৃষ্ঠে আছে প্রচুর “ফ্রি ইলেকট্রন” বা নেগেটিভ চার্জ। যখন আপনার খালি পা মাটি স্পর্শ করে, এই ইলেকট্রনগুলো আপনার শরীরে প্রবেশ করে এবং শরীরের পজিটিভ চার্জ নিউট্রালাইজ করে।

আমাদের আধুনিক জীবনে—মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি, ওয়াইফাই—সব জায়গা থেকে আমরা পজিটিভ চার্জ জমা করি। এতে শরীরে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। আর্থিং সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

ঠিক যেমন বাসায় আর্থিং তার থাকে বিদ্যুতের এক্সট্রা চার্জ মাটিতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য, আমাদের শরীরেরও দরকার এই প্রাকৃতিক আর্থিং।

বিজ্ঞান যা বলছে

১. প্রদাহ কমায়—দীর্ঘস্থায়ী রোগের মূলে আঘাত

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আর্থিং ব্যথা কমায় এবং রক্তে প্রদাহ সৃষ্টিকারী কোষের সংখ্যা পরিবর্তন করে। প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন হলো শরীরের একটি প্রতিক্রিয়া যা দীর্ঘমেয়াদে থাকলে আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

মাটি থেকে পাওয়া ইলেকট্রন শরীরের “ফ্রি র‍্যাডিক্যাল” নিউট্রালাইজ করে। ফ্রি র‍্যাডিক্যাল হলো এমন অস্থির অণু যা কোষের ক্ষতি করে। আর্থিং এদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়, ঠিক যেন শরীরের ভেতরে একটা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কাজ করছে।

২. হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে

একটি গবেষণায় প্রিহাইপারটেনশন রোগীদের উপর দেখা গেছে, মাত্র এক ঘণ্টা খালি পায়ে বসে থাকলে তাদের ডায়াস্টোলিক এবং সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

আরেকটি গবেষণায় ১০ জন উচ্চ রক্তচাপের রোগী প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা আর্থিং করার পর তাদের রক্তচাপ কমেছে এবং ওষুধের উপর নির্ভরতাও কমেছে।

আর্থিং রক্তকে পাতলা রাখতে সাহায্য করে, যা স্ট্রোক, হার্ট ডিজিজ এবং অন্যান্য কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি কমায়।

৩. ঘুম ভালো হয়—সকালে সতেজ অনুভব

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত আর্থিং করেন তারা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে পারেন, ঘুমের মান ভালো হয় এবং সকালে সতেজ অনুভব করেন।

কারণ, আর্থিং শরীরের কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) নিয়ন্ত্রণ করে। কর্টিসল স্বাভাবিকভাবে সকালে বেশি থাকে এবং রাতে কমে যায়। কিন্তু আধুনিক জীবনে স্ট্রেসের কারণে এই ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। আর্থিং এই প্রাকৃতিক ছন্দ ফিরিয়ে আনে।

৪. মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমায়

গবেষণায় দেখা গেছে আর্থিং মস্তিষ্কে সেরোটোনিন বাড়াতে পারে, যা সুখ এবং শান্তির অনুভূতি তৈরি করে।

ম্যাসাজ থেরাপিস্টদের উপর একটি গবেষণায়, যারা চার সপ্তাহ আর্থিং ম্যাট ব্যবহার করেছেন তারা তাদের ক্লান্তি এবং স্ট্রেস লেভেল কমার কথা জানিয়েছেন।

ডাক্তাররা এখন অনেক সময় উদ্বেগ এবং ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন এমন রোগীদের বলেন, “প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট খালি পায়ে বাইরে হাঁটুন।”

৫. পেশীর ব্যথা এবং রিকভারি

যারা ব্যায়ামের পর আর্থিং প্যাচ ব্যবহার করেছেন, তারা ব্যথা কম অনুভব করেছেন। খেলোয়াড় এবং ফিটনেস এনথুসিয়াস্টদের জন্য এটা বিশেষ উপকারী।

কীভাবে আর্থিং করবেন? সহজ উপায়

১. খালি পায়ে হাঁটুন

সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায়। প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট ঘাস, মাটি বা বালিতে খালি পায়ে হাঁটুন।

  • বাসার ছাদের বাগানে
  • পার্কে (রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান)
  • খেলার মাঠে
  • গ্রামের বাড়িতে গেলে মাঠে
  • সমুদ্র সৈকতে (কক্সবাজার, কুয়াকাটা)

ভেজা মাটিতে আর্থিং বেশি কার্যকর, কারণ আর্দ্রতা বিদ্যুৎ সঞ্চালন ভালো করে। তাই বৃষ্টির পর বা সকালে শিশিরে ভেজা ঘাসে হাঁটা আদর্শ।

২. মাটিতে বসুন বা শুয়ে পড়ুন

পার্কে গিয়ে ঘাসের উপর বসুন। পিকনিকে গেলে চাদর না পেতে সরাসরি মাটিতে বসুন। সমুদ্র সৈকতে বালিতে শুয়ে থাকুন।

৩. প্রাকৃতিক জলাশয়ে সাঁতার কাটুন

সমুদ্র, নদী, পুকুর—এসব প্রাকৃতিক জলাশয়ও আর্থিং এর কাজ করে। নোনা পানি বিশেষভাবে কার্যকর কারণ এটা ভালো কন্ডাক্টর।

৪. গার্ডেনিং করুন

বাগান করার সময় হাতে গ্লাভস না পরে খালি হাতে মাটি স্পর্শ করুন। এতেও আর্থিং হয়।

৫. ইনডোর অপশন: আর্থিং ম্যাট

যদি বাইরে যাওয়া সম্ভব না হয়, আর্থিং ম্যাট কিনতে পারেন। এগুলো বিদ্যুতের আর্থ পয়েন্টের সাথে সংযুক্ত থাকে। টেবিলে বসে কাজ করার সময় বা ঘুমানোর সময় ব্যবহার করতে পারেন।

কতক্ষণ করতে হবে!

মাত্র দুই সেকেন্ড খালি পায়ে মাটিতে দাঁড়ালেই শরীরে পরিমাপযোগ্য পরিবর্তন আসে। তবে সম্পূর্ণ উপকার পেতে প্রতিদিন অন্তত ২০-৩০ মিনিট করা ভালো।

কেউ কেউ বলেন ১০ মিনিটই যথেষ্ট। একটি গবেষণায় COVID-19 চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট আর্থিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ভালো খবর হলো, যত বেশি করবেন তত ভালো। সারাদিন খালি পায়ে থাকলে কোনো সমস্যা নেই, বরং বেশি উপকার।

আধুনিক বিজ্ঞান এখন যা আবিষ্কার করছে, আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানিরা সেটা বহুকাল ধরে জানতেন।

গ্রামে দেখেছেন বয়স্করা সকালে খালি পায়ে ঘাসে হাঁটতেন। বলতেন, “শিশির পড়া ঘাসে হাঁটলে পায়ের ব্যথা কমে, চোখ ভালো হয়।”

জার্মানিতে সেবাস্তিয়ান নাইপ নামের এক ধর্মযাজক ১৯ শতকে প্রতিদিন তিনবার খালি পায়ে হাঁটার পরামর্শ দিতেন, বিশেষ করে শিশিরে ভেজা ঘাসে। তিনি দিনে ২০০ জন রোগী দেখতেন এবং তার এই সাধারণ চিকিৎসা অনেককে সুস্থ করে তুলত।

চীনা, ভারতীয়, নেটিভ আমেরিকান—সব প্রাচীন সংস্কৃতিতে খালি পায়ে মাটিতে হাঁটার গুরুত্ব ছিল। তারা বিশ্বাস করত পৃথিবীর শক্তি আমাদের সুস্থ রাখে।

আমরা আধুনিক হতে গিয়ে এই সহজ জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবার ফিরে আসছি।

আর্থিং সাধারণত নিরাপদ, কিন্তু কিছু সতর্কতা মেনে চলুন:

১. কাঁটা বা কাচ থেকে সাবধান: যেখানে হাঁটছেন সেখানে কাঁটা, কাচ বা ধারালো কিছু নেই কিনা দেখে নিন।

২. পরিষ্কার জায়গা বেছে নিন: নোংরা বা কেমিক্যাল দেওয়া জায়গায় খালি পায়ে হাঁটবেন না।

৩. ধীরে ধীরে শুরু করুন: প্রথমে ৫-১০ মিনিট দিয়ে শুরু করুন, তারপর বাড়ান। হঠাৎ অনেকক্ষণ হাঁটলে পায়ে ব্যথা হতে পারে।

৪. ডাক্তারের পরামর্শ: যদি কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ থাকে (ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা) বা সম্প্রতি সার্জারি হয়ে থাকে, ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।

৫. আর্থিং চিকিৎসার বিকল্প নয়: এটা স্বাস্থ্য উন্নত করার একটা সহায়ক উপায়, কিন্তু রোগের চিকিৎসা বাদ দেওয়া যাবে না।

প্রকৃতির সাথে যুক্ত হওয়া!

আর্থিং বা গ্রাউন্ডিং কোনো জাদুকরী সমাধান নয়, কিন্তু এটি একটি শক্তিশালী এবং প্রাকৃতিক উপায় যা আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে।

আধুনিক জীবনে আমরা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। জুতা, কংক্রিট, ইনডোর জীবন—এসব আমাদের পৃথিবীর সাথে সংযোগ ছিন্ন করে দিয়েছে। আর তার ফলাফল দেখছি আমরা—বাড়তে থাকা স্ট্রেস, ঘুমের সমস্যা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ।

আর্থিং সেই হারানো সংযোগ ফিরিয়ে দেয়। এটা সম্পূর্ণ ফ্রি, সহজ এবং কার্যকর। বিজ্ঞান এখন প্রমাণ করছে যা প্রাচীন মানুষেরা হাজার বছর ধরে জানত—পৃথিবী নিরাময় করে।

আজ থেকেই শুরু করুন। সকালে মাত্র ১০-১৫ মিনিট খালি পায়ে হাঁটুন। পার্কে যান, ছাদের বাগানে সময় কাটান, সমুদ্র সৈকতে বালিতে পা ডুবিয়ে বসুন। এবং অনুভব করুন পৃথিবী কীভাবে আপনাকে নিরাময় করছে।

প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট—এই ছোট্ট বিনিয়োগ আপনার জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। কোনো খরচ নেই, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই—শুধু প্রকৃতির সাথে আবার যুক্ত হওয়া।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular