ভাবুন তো—প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে ডাক্তার বলছেন রোজ অন্তত ১০ হাজার স্টেপ হাঁটা দরকার। আপনি একদিন হাঁটলেন, দুইদিন হাঁটলেন, তারপর অফিস, পরিবার, যানজট—সব মিলিয়ে আর হয়ে উঠলো না। “আহা! এত সময় কোথায় পাবো?”—এটাই মনে হয় আমাদের সবার প্রথম প্রতিক্রিয়া।
ঢাকার রাস্তায় বা গলিতে হাঁটা সহজ কাজ নয়। কখনো যানজট, কখনো ভিড়, কখনো আবার সময়ের অভাব। অথচ সুস্থ থাকতে চাইলে নড়াচড়া করতেই হবে। এখানে আসে এক দারুণ খবর—গবেষণায় প্রমাণিত, প্রতিদিন মাত্র কয়েক মিনিটের সিঁড়ি ওঠা-নামা করতে পারলেই আপনি পেয়ে যাবেন ১০ হাজার স্টেপ হাঁটার সমান উপকার!
কেন হাঁটা এত গুরুত্বপূর্ণ?
চিকিৎসকরা বলেন, হাঁটা হলো সবচেয়ে প্রাকৃতিক এবং সহজ ব্যায়াম। রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, হার্ট মজবুত হয়, ফুসফুস ভালো থাকে, হাড় ও পেশির শক্তি বাড়ে। যারা নিয়মিত হাঁটেন, তাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এমনকি মানসিক চাপও কম থাকে।
তবে সমস্যা হলো—“১০ হাজার স্টেপ” সংখ্যাটা শুনলেই মনে হয়, এটা কোনো ম্যারাথনের মতো! অনেকেই ভেবে বসেন, “আমি তো এত হাঁটতে পারবো না।” ফলাফল—হাঁটার অভ্যাসই তৈরি হয় না।
গবেষণার নতুন আলো
সাম্প্রতিক এক গবেষণা (Canadian Journal of Cardiology, 2024) দেখিয়েছে, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শরীরের জন্য অবিশ্বাস্য রকমের কার্যকর। মাত্র কয়েক মিনিট ধরে সিঁড়ি ওঠা-নামা করলে, সেটি আপনার শরীরে ঠিক ততটাই প্রভাব ফেলে যতটা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটার ফলে হয়।
কারণ, সিঁড়ি ওঠা হলো একধরনের হাই-ইনটেনসিটি এক্সারসাইজ (HIIT)। এখানে আপনার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়, মাংসপেশি ও হাড় বেশি শক্তিশালী হয়, এবং ক্যালরি পোড়ার হার অনেক বেশি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিদিন ১০–১৫ মিনিট সিঁড়ি ওঠা-নামা করলে তা ১০ হাজার স্টেপ হাঁটার সমান উপকার দিতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটা কার্যকর?
আমাদের এখানে অনেক সময় পার্কে গিয়ে বা রাস্তায় নিরাপদে হাঁটার সুযোগ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে সকালে সময় পাওয়া মানেই যুদ্ধ।
কিন্তু সিঁড়ি? সেটা তো ঘরেই আছে! বাসায় থাকলে ফ্ল্যাটের সিঁড়ি, অফিসে গেলে বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি—যেখানেই হোক ব্যবহার করা যায়।
উদাহরণ: রুবাইয়া নামের এক তরুণী আইটি কোম্পানিতে কাজ করেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৬টা অফিস, তারপর ট্রাফিকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরা। পার্কে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—প্রতিদিন অফিসের লিফট বাদ দিয়ে ৬ তলা পর্যন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠবেন। শুরুতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর তিনি বুঝলেন তার শ্বাসকষ্ট কমছে, ওজনও ধীরে ধীরে কমছে। সবচেয়ে বড় কথা—তিনি আগের তুলনায় অনেক বেশি এনার্জেটিক বোধ করছেন।
সিঁড়ি ওঠা কিভাবে করবেন?
শুধু হুটহাট উঠে পড়া নয়, এখানে কিছু নিয়ম মেনে চললে উপকার বেশি হবে এবং শরীরের ক্ষতিও হবে না।
- শুরু করুন ধীরে ধীরে – প্রথমদিন ৫ মিনিট, তারপর ধীরে ধীরে সময় বাড়ান।
- ব্রেক নিন – টানা দৌড়ে উঠতে হবে না। দুইতলা উঠলেন, এক মিনিট বিরতি নিয়ে আবার শুরু করুন।
- কমফোর্টেবল পোশাক ও জুতা ব্যবহার করুন – পা ফসকে যাওয়ার ঝুঁকি কমবে।
- হার্ট রেট মনিটর করুন – খুব বেশি ক্লান্তি এলে সঙ্গে সঙ্গে থামুন।
- লক্ষ্য ধরুন – প্রথমে ১০ মিনিট, পরে ১৫–২০ মিনিট পর্যন্ত নিতে পারেন।
উপকারিতা এক নজরে
- হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো রাখে – কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস বাড়ে।
- ক্যালরি দ্রুত পোড়ে – সাধারণ হাঁটার চেয়ে দ্বিগুণ ক্যালরি বার্ন হয়।
- হাড় ও পেশি শক্তিশালী হয় – বিশেষ করে পায়ের মাংসপেশি ও হাড়ে।
- স্ট্রেস কমায় – এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, মুড ভালো থাকে।
- সময়ের সাশ্রয় হয় – ৩০–৪০ মিনিট হাঁটার বদলে কয়েক মিনিটেই সমান উপকার।
গল্পের ভেতর থেকে শিক্ষা
বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষও দিনে ১০–১৫ মিনিট সিঁড়ি ওঠা-নামা করতে পারেন। অফিসে লিফট বাদ দিয়ে সিঁড়ি ধরুন, বাসায় রাতে ডিনারের পর কয়েকবার ওঠানামা করুন—এতটুকুই যথেষ্ট।
শাহিন নামের এক ব্যাংকারের গল্প ধরা যাক। সারাদিন ডেস্কে বসে কাজ করেন, ফলে ওজন বেড়ে গিয়েছিলো। ডাক্তারের পরামর্শে তিনি প্রতিদিন লিফট বাদ দিয়ে ৮ তলা পর্যন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওঠা শুরু করলেন। কয়েক মাস পর ওজন কমলো, ব্লাড প্রেসারও নরমাল হলো। তিনি মজা করে বললেন—“জিমে না গিয়েও আমি নিজের অফিস বিল্ডিংকেই জিম বানিয়ে ফেলেছি!”
আমাদের মানসিকতায় ছোট পরিবর্তন
আমরা অনেক সময় ভাবি—সুস্থ থাকতে হলে অনেক বড় পদক্ষেপ নিতে হবে। আসলে সত্য হলো, ছোট ছোট নিয়মিত অভ্যাসই বড় পরিবর্তন আনে। প্রতিদিন কয়েক মিনিট সিঁড়ি ওঠা তারই একটি সহজ উপায়।
তাই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন—আজ আপনি লিফট বাদ দিয়ে কয়তলা উঠতে প্রস্তুত?
১০ হাজার স্টেপ হাঁটা অবশ্যই ভালো, কিন্তু সময় না পেলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সিঁড়ি ওঠা হলো আপনার হাতের কাছের সেরা সমাধান।
এটি সময় বাঁচায়, শরীর ফিট রাখে, আর স্বাস্থ্যকে করে আরও শক্তিশালী।
আজ থেকেই চেষ্টা শুরু করুন। প্রথমে হয়তো হাঁপিয়ে উঠবেন, কিন্তু কিছুদিন পর দেখবেন—শরীরটা হালকা লাগছে, মন ভালো হচ্ছে, আর আপনি হয়ে উঠছেন আরও সুস্থ ও উদ্যমী।
কারণ, সুস্থতা মানেই ব্যায়ামের জন্য আলাদা সময় বের করা নয়—বরং প্রতিদিনের জীবনকেই ব্যায়ামে পরিণত করা। আর সেই সুযোগটা আপনার ঘরের সিঁড়িই সহজে এনে দেবে।
এভাবেই “রোজ কয়েক মিনিটের এই ব্যায়াম” আপনার জীবনকে পাল্টে দিতে পারে—শরীরেও, মনের এনার্জিতেও।