উদ্যোক্তাদের প্রতিদিনের কাজের চাপ এত বেশি যে ২৪ ঘণ্টাও অনেক সময় কম মনে হয়। সারাদিন দৌড়াতে থাকে—মিটিং, প্ল্যানিং, ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট, টিম লিডিং—সব মিলিয়ে কাজ শেষ হয় না, আবারও স্ট্রেস তৈরি হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ উদ্যোক্তারই নির্দিষ্ট টাইম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নেই, যা প্রোডাক্টিভিটিকে সরাসরি কমিয়ে দেয়। কিন্তু সফল উদ্যোক্তারা সময়কে এমনভাবে ব্যবহার করেন যে একই দিনে অনেক বেশি কাজ করে ফেলেন—কারণ তারা স্মার্ট সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ম মেনে চলেন।
সময় ব্যবস্থাপনার সেই ৭টি শক্তিশালী নিয়ম, যা আপনার দিন, কাজ এবং ব্যবসার গ্রোথকে বদলে দিতে পারে।
১. Eisenhower Matrix — জরুরি আর গুরুত্বপূর্ণের পার্থক্য বুঝুন
অনেক উদ্যোক্তা দিন শুরু করেন ইমেইল দেখে বা হঠাৎ আসা জরুরি কাজ সামলে। কিন্তু Eisenhower Matrix শেখায়—সব জরুরি কাজ আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কাজকে চার ভাগে ভাগ করলে বোঝা যায় আপনি কোথায় সময় নষ্ট করছেন এবং কোথায় ফোকাস করা উচিত।
- গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি কাজ অবশ্যই আগে করতে হবে—যেমন ক্লায়েন্ট ক্রাইসিস বা জরুরি ডেডলাইন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরি নয় এমন কাজগুলো
- যেমন স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং বা নতুন প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট—সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। অনেকেই এই অংশে সময় দেন না, ফলে গ্রোথ আটকে যায়। জরুরি কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ
- ডেলিগেট করলেই সময় বাঁচে, আর অপ্রয়োজনীয় কাজ
- বাদ দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে ৫ মিনিট দিয়ে কাজগুলো এই ম্যাট্রিক্সে সাজালেই আপনি অনেক বেশি কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবেন।
২. Time Blocking — নিজের সময় নিজের জন্য বুক করুন
Time Blocking মূলত দিনের নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট কাজে বরাদ্দ করা। এতে মস্তিষ্ক জানে কোন সময় কোন কাজ করতে হবে, ফলে মাল্টিটাস্কিং কমে যায় এবং Deep Work করা সহজ হয়।
উদ্যোক্তারা সাধারণত সকাল সময়ে সবচেয়ে বেশি ফোকাসড থাকেন—এই সময় স্ট্র্যাটেজিক কাজ বা প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট রাখলে ফলাফল ভালো হয়। আবার মিটিং, ইমেইল বা টিম কলের জন্য আলাদা ব্লক রাখলে অযথা বিঘ্ন কমে। বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা অনেক সময় কাজের মাঝে অনেক কল বা ভিজিটের সম্মুখীন হন।
তাই, ফোকাস টাইম সম্পর্কে টিমকে আগে থেকেই জানানো জরুরি।
৩. 2-Minute Rule — ছোট কাজ জমতে দেবেন না
ডেভিড অ্যালেনের ফেমাস এই নিয়ম বলে—যে কাজ ২ মিনিট লাগবে, তা এখনই করে ফেলুন। ছোট ছোট কাজগুলো টু-ডু লিস্টে রেখে দিলে সেগুলো মানসিক চাপ তৈরি করে এবং কাজের তালিকা বড় করে দেয়। দ্রুত উত্তর দেওয়ার মতো ইমেইল, ছোটখাটো আপডেট, বা একটি ফাইল পাঠানো—এসব তাৎক্ষণিক করলে আপনার মস্তিষ্ক হালকা থাকে এবং দিনের শুরুতে মোমেন্টাম তৈরি হয়।
তবে একটার পর একটা ছোট কাজ করতে করতে যেন মূল কাজের সময় নষ্ট না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে।
৪. Delegate or Die — সব কাজ নিজে করা মানে ব্যবসাকে ধীর করা
অনেক উদ্যোক্তা ভাবেন—“আমি করলে ভালো হবে”—কিন্তু এই অভ্যাস ব্যবসার গ্রোথ ধীর করে।
বাস্তবে দেখলে দেখা যায় উদ্যোক্তার সময়ের বেশিরভাগ নষ্ট হয় লো-ভ্যালু কাজগুলোতে। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করা, ডাটা এন্ট্রি, ফলো-আপ কল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেট করা, বা বেসিক কাস্টমার সাপোর্ট—এসব সহজেই ডেলিগেট করা যায়।
ভালো ডেলিগেশন মানে পরিষ্কার নির্দেশনা, ডেডলাইন, রিসোর্স এবং নিয়মিত চেক-ইন। বাংলাদেশে দক্ষ ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট খুবই সাশ্রয়ী, যারা উদ্যোক্তাদের সময় ৫০–৮০ ঘণ্টা পর্যন্ত সেভ করতে পারে।
৫. Pomodoro Technique — ফোকাসের সবচেয়ে সহজ সিস্টেম
এই পদ্ধতির মাধ্যমে ২৫ মিনিট ফোকাসড কাজ ও ৫ মিনিট বিরতি নেওয়া হয়।
চারটি Pomodoro শেষ হলে লম্বা বিরতি। ছোট সময়ের এই শক্তিশালী স্প্রিন্টগুলো প্রোক্র্যাস্টিনেশন কমায় এবং মস্তিষ্ককে ফ্রেশ রাখে।
গবেষণায় দেখা যায় Pomodoro ব্যবহারকারীরা দিনে ৩০–৪০% বেশি ফোকাসড থাকে। বিশেষ করে যখন ক্রিয়েটিভ কাজ বা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং করবেন—এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।
৬. Email Batching — ইমেইলকে দিনটি নিয়ন্ত্রণ করতে দেবেন না
McKinsey–র গবেষণা অনুযায়ী, একজন প্রফেশনাল সপ্তাহে ১১ ঘণ্টা ইমেইলে ব্যয় করেন। উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি। ইমেইল কখনোই দিনের প্রথম কাজ হওয়া উচিত নয়—এটি পুরো দিনকে রিঅ্যাক্টিভ করে দেয়।
সমাধান হলো Email Batching—দিনে ২–৩টি নির্দিষ্ট সময়ে ইমেইল চেক ও রেসপন্স করুন। এতে অযথা বিঘ্ন কমে এবং Deep Work সম্ভব হয়। একই ধরনের ইমেইলের জন্য টেমপ্লেট তৈরি থাকলে সময় আরও কম লাগে।
ইনবক্সে থাকা প্রতিটি ইমেইলের ভবিষ্যত নিয়ম ঠিক করুন—Delete, Delegate, Reply বা Later Folder—ইহাই Inbox Zero।
৭. Weekly Review — সপ্তাহে একবার নিজের কাজকে মূল্যায়ন করুন
সপ্তাহ শেষে ৩০–৬০ মিনিটের একটি রিভিউ সেশন উদ্যোক্তার প্রোডাক্টিভিটি বহুগুণ বাড়াতে পারে। এ
ই সময় আপনি দেখবেন—এই সপ্তাহে কী অর্জন করলেন, কোন লক্ষ্য ছুঁতে পারেননি এবং কেন পারেননি।
এরপর পরবর্তী সপ্তাহের জন্য ৩টি প্রধান লক্ষ্য ঠিক করুন। এ ছাড়া কীভাবে আরও ভালো করা যায় তা নির্ধারণ করুন। Weekly Review আপনার কাজ, টিম এবং ব্যবসার গতি সবকিছুই উন্নত করে।
সময় আপনার সবচেয়ে বড় অ্যাসেট
উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে দক্ষতার চেয়ে সময় ম্যানেজমেন্ট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই ৭টি নিয়ম যদি ধীরে ধীরে আপনার রুটিনে যোগ করেন—আপনার ব্যবসা, কাজের চাপ এবং মানসিক শান্তি—সবকিছুই বদলে যাবে। শুরুতে সব নিয়ম একসাথে প্রয়োগ করতে হবে না। প্রথমে ২–৩টি অভ্যাস নিন, তারপর বাকি গুলো যোগ করুন।
মনে রাখবেন, উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আপনার ফোকাস। আর ফোকাস তখনই জন্মায়, যখন সময় সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা হয়।

