২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ আব্দুলআজিজ বিন আব্দুল্লাহ আল আশ-শাইখের ইন্তেকাল একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছে। তিনি শুধুমাত্র সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ছিলেন না, বরং বৈশ্বিক মুসলিম উম্মাহর একজন অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আধুনিক সৌদি সমাজে যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা একটি জটিল চ্যালেঞ্জ, সেখানে তার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিক পটভূমি
আল আশ-শাইখ পরিবার সৌদি আরবের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত। এই বংশের শিকড় মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত, যিনি ১৮শ শতকে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। শাইখ আব্দুলআজিজ ছিলেন সৌদি আরবের তৃতীয় গ্র্যান্ড মুফতি, মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম আল আশ-শাইখ এবং আব্দুল আজিজ বিন বাজের পরবর্তী উত্তরসূরি।
এই পরিবারের ধর্মীয় ঐতিহ্য সৌদি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা থেকেই রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের মাধ্যমেই সৌদি আরবে শরিয়াহ ভিত্তিক আইনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।
ধর্মীয় নেতৃত্বে ভূমিকা
গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে শাইখ আব্দুলআজিজের প্রধান দায়িত্ব ছিল আইনগত বিষয় ও সামাজিক বিষয়াদিতে মতামত (ফতোয়া) প্রদান করা। তিনি কাউন্সিল অব সিনিয়র রিলিজিয়াস স্কলারস এবং ইসলামিক রিসার্চ ও ফতোয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির প্রধান ছিলেন।
তার ফতোয়া ও ধর্মীয় দিকনির্দেশনা শুধু সৌদি আরবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি মক্কায় অবস্থিত একজন ইসলামিক স্কলার হিসেবে বিশ্বব্যাপী সালাফি মুসলিমদের বিস্তৃত আন্দোলনে একজন প্রধান আলেম হিসেবে প্রভাব বিস্তার করেছেন।
ধর্মীয় নীতিমালা নির্ধারণে প্রভাব
শাইখ আব্দুলআজিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির মধ্যে রয়েছে হজ ও ওমরাহ পালনে আধুনিক সুবিধার সাথে ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে নারীর অধিকার, শিক্ষা, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো আধুনিক ইস্যুতে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
তার কিছু উল্লেখযোগ্য ফতোয়ার মধ্যে রয়েছে নারীদের গাড়ি চালানো, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মিশ্র পরিবেশে কাজের বিষয়ে নির্দেশনা। যদিও তার এসব মতামত কখনো কখনো রক্ষণশীল হিসেবে সমালোচিত হয়েছে, তবুও তিনি ধীরে ধীরে আধুনিক প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ফতোয়া প্রদান করেছেন।
শাসন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক
সৌদি আরবের রাজপরিবার ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি রয়েছে। এই ব্যবস্থায় শাইখ আব্দুলআজিজ রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মীয় বৈধতা প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
Vision 2030 ও আধুনিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকা অত্যন্ত জটিল ছিল। একদিকে তিনি ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক মূল্যবোধ রক্ষার পক্ষে ছিলেন, অন্যদিকে রাষ্ট্রের আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করতেন। বিশেষ করে নারীর অধিকার বিস্তার, বিনোদন শিল্পের উন্নয়ন, এবং অর্থনৈতিক সংস্কারে ধর্মীয় বৈধতা প্রদানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
সমালোচনা ও বিতর্ক
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শাইখ আব্দুলআজিজের কিছু বক্তব্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার রক্ষণশীল অবস্থানের কারণে মানবাধিকার সংগঠনগুলো কখনো কখনো তার মতামতের সমালোচনা করেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যমে তার কিছু ফতোয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
তরুণ সৌদি প্রজন্মের প্রত্যাশা এবং প্রচলিত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আধুনিকতার সাথে ইসলামিক শিক্ষার সমন্বয় সাধনে তিনি ক্রমান্বয়ে আরও নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।
বৈশ্বিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার
গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে তিনি কাউন্সিল অব সিনিয়র রিলিজিয়াস স্কলারস এবং ইসলামিক রিসার্চ ও ফতোয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা পুরো মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় আলোচনাকে প্রভাবিত করেছে। মুসলিম বিশ্ব লীগের সর্বোচ্চ কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে তিনি বিভিন্ন ইসলামিক মাযহাবের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরিতে কাজ করেছেন।
তার নেতৃত্বকাল এমন একটি সময়ে পড়েছিল যখন বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল ছিল। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং বৈশ্বিক যোগাযোগের এই যুগে ইসলামিক শিক্ষা কীভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
শাইখ আব্দুলআজিজ আল আশ-শাইখের ইন্তেকালের সাথে সাথে সৌদি আরব এবং ইসলামিক বিশ্ব একজন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতাকে হারিয়েছে। আধুনিক সৌদি আরবে ধর্মীয় নেতৃত্বের গুরুত্ব তার জীবন ও কর্মের মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝা যায়।
তার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো স্থানীয় বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক ঐক্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। তিনি প্রমাণ করেছেন যে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আধুনিক প্রয়োজনের মধ্যে সমন্বয় সম্ভব, যদিও এই প্রক্রিয়া সহজ নয়।
ভবিষ্যতে সৌদি আরবের নতুন ধর্মীয় নেতৃত্ব কীভাবে তার উত্তরাধিকার এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে ইসলামিক শিক্ষার সমন্বয় করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তার জীবন ও কর্ম প্রমাণ করে যে ধর্মীয় নেতৃত্ব শুধু আধ্যাত্মিক নির্দেশনা নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত একটি প্রক্রিয়া।