মনে করুন আপনি টিভির সামনে বসে আছেন। হঠাৎ পর্দায় ভেসে উঠল একটি ছোট্ট ঘর। দেয়ালে পুরনো ছবি ঝুলছে, কোণায় পড়ে আছে বাচ্চাদের খেলনা। একটি নরম কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “হর ঘর কুছ কেহতা হ্যায়।” হঠাৎ করেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠল আপনার নিজের ঘরের কথা, পরিবারের সাথে কাটানো সেই মুহূর্তগুলোর কথা।
এই যে মুহূর্তে একটি রঙের বিজ্ঞাপন আপনার হৃদয়ে পৌঁছে গেল, এটাই পিয়ূষ পান্ডের জাদু। তিনি এমন এক মানুষ যিনি বিজ্ঞাপনকে শুধু পণ্য বিক্রির মাধ্যম না রেখে তাকে আমাদের জীবনের গল্পে পরিণত করেছেন।
একজন স্বপ্নদর্শীর গল্প
জয়পুরের এক সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা পিয়ূষ পান্ডে প্রথমে ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার পর যখন বিজ্ঞাপনের জগতে পা রাখলেন, তখন হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না যে একদিন তিনি পুরো একটি শিল্পের মুখ বদলে দেবেন।
১৯৮০-এর দশকে অগিলভি ইন্ডিয়ায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই পিয়ূষ বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতীয় মানুষের সাথে কথা বলতে হলে তাদের ভাষায়, তাদের আবেগের ভাষায় কথা বলতে হবে। তিনি প্রায়ই বলতেন, “যদি তোমার মা তোমার বিজ্ঞাপন না বুঝে, তাহলে সেটা ভালো বিজ্ঞাপন নয়।” এই সহজ দর্শনেই লুকিয়ে ছিল তার সফলতার চাবিকাঠি।
যখন দেয়াল কথা বলতে শুরু করল
এশিয়ান পেইন্টসের সেই বিখ্যাত ক্যাম্পেইনের কথা মনে আছে? “হর ঘর কুছ কেহতা হ্যায়” – প্রতিটি ঘর কিছু না কিছু বলে। পিয়ূষ পান্ডে এই একটি লাইনে ক্যাপচার করেছিলেন আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ের গভীর একটি সত্য।
আমরা সবাই জানি আমাদের ঘরের দেয়ালগুলো শুধু ইট-সিমেন্টের নয়। সেগুলো আমাদের হাসি-কান্নার সাক্ষী, আমাদের স্বপ্ন-আশার ধারক। যখন একটি রঙের কোম্পানি এই আবেগকে স্পর্শ করল, তখন সেটা আর শুধু রং হয়ে রইল না – হয়ে উঠল আমাদের পরিচয়ের অংশ।
পিয়ূষ পান্ডে বুঝেছিলেন যে ভারতীয় মানুষ কেবল পণ্য কিনে না, তারা গল্প কিনে, আবেগ কিনে, স্বপ্ন কিনে। তাই তিনি রঙের বিজ্ঞাপনে রঙের গুণগান না করে বলতে শুরু করলেন পরিবারের গল্প, ভালোবাসার গল্প।
ফেভিকলের অদ্ভুত যাদু
আর ফেভিকলের কথা না বললেই নয়। একটি আঠার কোম্পানি কীভাবে ভারতীয় পপ কালচারের অংশ হয়ে উঠল? পিয়ূষ পান্ডের হাত ধরেই।
মনে আছে সেই বিখ্যাত বাসের বিজ্ঞাপন? যেখানে একটি বাসে এত মানুষ উঠেছে যে সেটা প্রায় ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা, কিন্তু ফেভিকলের জোরে সবাই আটকে আছে? এই বিজ্ঞাপনটি দেখে আমরা সবাই হেসেছি, কারণ এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি চেনা দৃশ্য।
পিয়ূষ এখানে আঠার শক্তির কথা বলেননি, তিনি বলেছেন আমাদের জীবনের সেই মুহূর্তগুলোর কথা যখন আমরা সবাই একসাথে আটকে যাই – হোক সেটা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কিংবা পারিবারিক বন্ধনে।
হাস্যরস যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়
পিয়ূষ পান্ডের বিজ্ঞাপনে হাস্যরস ছিল, কিন্তু সেটা ছিল এমন হাস্যরস যা আমাদের হাসানোর সাথে সাথে ভাবিয়েও দিত। তার হাস্যরস ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয়।
সেই মাছ ধরার নৌকার বিজ্ঞাপনটির কথা ভাবুন। একটি নৌকা এত মাছে ভর্তি যে সেটা ডুবে যাওয়ার কথা, কিন্তু ফেভিকলের কারণে সব কিছু ঠিকঠাক আটকে আছে। এই দৃশ্যটি দেখে আমরা শুধু হাসিনি, আমরা একটি সুন্দর স্বপ্নও দেখেছি – এমন একটি জগতের যেখানে সব কিছু নিরাপদে আটকে থাকে।
যখন বিজ্ঞাপন জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠে
পিয়ূষ পান্ডে শুধু বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি জাতীয় প্রচারণাগুলোতেও তার জাদু ছড়িয়েছেন। “মিলে সুর মেরা তুমহারা” – এই গানটি শুনলে আজও আমাদের বুকে একটা গর্বের অনুভূতি জাগে।
এটি কোনো সাধারণ বিজ্ঞাপন ছিল না, এটি ছিল ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের একটি উদযাপন। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা শিল্পীরা যখন একসাথে গান গাইলেন, তখন মনে হলো পুরো দেশটাই একসাথে গান গাইছে।
আবার “দো বুন্দ জিন্দেগি কি” – পালস পোলিও ক্যাম্পেইনটি দেখুন। এখানে তিনি শুধু টিকাদানের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেননি, তিনি প্রতিটি মা-বাবার হৃদয়ে পৌঁছেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন যে এই দুই ফোঁটা কেবল ওষুধ নয়, এটি তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।
মানুষের ভাষায় কথা বলার শিল্প
পিয়ূষ পান্ডের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার সহজ হওয়ার ক্ষমতা। তিনি জটিল বিপণন কৌশল বা চমকপ্রদ গ্রাফিক্সের উপর নির্ভর করতেন না। তিনি নির্ভর করতেন মানুষের আবেগের উপর, তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার উপর।
তার প্রতিটি বিজ্ঞাপন যেন একটি কথোপকথন। যেন তিনি আমাদের পাশে বসে আমাদের সাথে গল্প করছেন। তিনি কখনো উপর থেকে কিছু চাপিয়ে দিতেন না, বরং আমাদের মনের ভাবনাগুলোকে সুন্দর ভাষায় প্রকাশ করে দিতেন।
এই কারণেই তার বিজ্ঞাপনগুলো কেবল বিজ্ঞাপন হয়ে থাকত না, হয়ে উঠত আমাদের স্মৃতির অংশ। আজও যখন কোনো শক্তিশালী বন্ধনের কথা বলি, আমরা বলি “ফেভিকল কা মজবুত জোড়”। যখন ঘরের কথা বলি, মনে পড়ে যায় “হর ঘর কুছ কেহতা হ্যায়”।
একটি উত্তরাধিকারের গল্প
আজ যখন ডিজিটাল যুগে আমরা প্রতিদিন হাজারো বিজ্ঞাপন দেখি, তখনও পিয়ূষ পান্ডের সৃষ্টিগুলো আলাদাভাবে মনে থেকে যায়। কেন? কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে প্রযুক্তি বদলায়, মাধ্যম বদলায়, কিন্তু মানুষের আবেগ বদলায় না।
তার পদ্মশ্রী পুরস্কার কিংবা কান লায়ন্সের মতো আন্তর্জাতিক সম্মাননা তার কাজের স্বীকৃতি। কিন্তু সত্যিকারের স্বীকৃতি হলো এই যে, আজও যখন কোনো নতুন বিজ্ঞাপনদাতা ভারতীয় মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, তখন তারা পিয়ূষ পান্ডের পথেই হাঁটার চেষ্টা করে।
আজকের যুগে পিয়ূষ পান্ডের শিক্ষা
আজকের ডিজিটাল যুগে, যখন এআই এবং বিগ ডেটা দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে, তখন পিয়ূষ পান্ডের শিক্ষা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তিনি শিখিয়েছেন যে কোনো অ্যালগরিদম আবেগের চেয়ে শক্তিশালী নয়, কোনো ডেটা মানুষের হৃদয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আজকের তরুণ উদ্যোক্তারা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং মার্কেটারদের জন্য তার বার্তা সহজ: “জটিল হওয়ার চেষ্টা করো না, সৎ হওয়ার চেষ্টা করো। মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করো না, তাদের সাথে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করো।”
যে মানুষটি বিজ্ঞাপনকে গল্প বানিয়েছেন
পিয়ূষ পান্ডে আসলে একজন গল্পকার। তিনি বিজ্ঞাপন বানানোর চেয়ে গল্প বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। এবং সেই গল্পগুলো এমন ছিল যে সেগুলো আমাদের নিজেদের গল্প মনে হতো।
তিনি প্রমাণ করেছেন যে সত্যিকারের যোগাযোগ হয় হৃদয়ের ভাষায়, মাথার ভাষায় নয়। তিনি দেখিয়েছেন যে একটি ভালো বিজ্ঞাপন কেবল পণ্য বিক্রি করে না, এটি মানুষের জীবনে একটি ছোট্ট খুশির মুহূর্ত যোগ করে।
আজ যখন আমরা তার কাজের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় তিনি কেবল বিজ্ঞাপনই বানাননি, তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি অংশ তৈরি করেছেন। তার সৃষ্টি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কারা, আমরা কীসে বিশ্বাস করি, আমরা কী নিয়ে হাসি। এবং সেটাই হয়তো একজন সত্যিকারের শিল্পীর সবচেয়ে বড় উপহার – এমন কিছু সৃষ্টি করা যা কেবল দেখা হয় না, অনুভব করা হয়।

