একবার আমি আমার বান্ধুবি পায়েলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম হঠাৎ করে একটা আলাদিনের চেরাগ পেয়ে গেলে দৈত্যের কাছে কি চাইবে?সে আমাকে উত্তরে বলেছিলো, দৈত্যকে বলবো, আমি যত খুশি খেতে চাই কিন্ত মোটা হতে চাই না৷
এসব আমরা যতোই বলি না কেন,বাস্তবিকভাবে এটা সম্ভব নয়। বাড়ন্ত ওজন সবার কাছেই বেশ ভয়ের কারণ! এইতো সেদিন দেখি আমার ক্লাস ফোরে পড়া ছোটবোনটা চকলেট কেক খেতে চাচ্ছিলো না। আগে যার জন্য কেউ চকলেট কেকে হাতও দিতে পারতো না, সে-ই কিনা বলে মোটা হয়ে যাবো! আরও বললো, “চকলেট কেকে তো অনেক ফ্যাট!”
আধুনিকতার এই যুগে তেরো বছরের কিশোরী থেকে তেষট্টি বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ পর্যন্ত সবারই খেতে বসলে মাথায় থাকে একই চিন্তা- ‘বেশি খাওয়া যাবে না, মোটা হয়ে যাবো।’ ওজন কম রাখার চেষ্টা মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা গেলেও পুরুষদের মধ্যে কিন্তু কম নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওজন কমানোর চেষ্টাগুলো হয় ভুল পদ্ধতিতে এবং না বুঝে। আবার এমন অনেকেই আছে যারা ব্যায়াম করবো করবো বলেও করে না। অনেকে আবার সুন্দর ফিগার বলতে জিরো ফিগারকেই বোঝেন। কিন্তু জিরো ফিগার স্বাস্থ্যকর নয় এটা তারা জানেই না। বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী প্রত্যেকের শরীরেরই একটি নির্দিষ্ট ওজন রাখার প্রয়োজন আছে, যা তার শরীরের মেটাবলিজম বাড়ানোর জন্য খুবই প্রয়োজন। আসুন তাহলে জেনে নিই কীভাবে নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন সহজেই:
কোনো বেলার খাবার, বাদ যাবে না আর!
ইচ্ছা কী? ওজন কমানো! কিন্ত এখন যে একটা বিয়ের দাওয়াত? আচ্ছা তাতে সমস্যা নেই! এখন পেট ভরে খাই রাতে আর খাবো না। কিংবা গতকালের হ্যাংআউটে গল্পের তালে তালে কখন যে দুইটা বার্গার খেয়ে ফেলেছি, খেয়ালই নেই! তাহলে আজকের লাঞ্চটা আর না করি।
উপরের কথাগুলো যেন আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। যেন একবেলা না খেয়ে ওজন ব্যালেন্স করে নিলাম! কিন্তু এসব ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের ওজন কমাতে কোনো সাহায্য তো করেই না বরং মেটাবলিজম কমিয়ে দেয়। আর মেটাবলিজম কমে যাওয়ার মানে ওজন কমার গতিও ধীর হয়ে যাওয়া। পাশাপাশি খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি, ক্লান্তি-এসব সমস্যা তো আছেই।
ব্রেকফাস্টে নিন একটি ডিম প্রতিদিন
সকালে বাচ্চাদের স্কুল কিংবা বাবা-মায়ের অফিস-প্রত্যেকেরই থাকে বেশ তাড়াহুড়ো। সকালের সেই তাড়াহুড়োয় ব্যাগ না গুছিয়ে, রেডি না হয়ে কেউ বাইরে যেতে পারবো না- এটা সবাই জানি। কিন্তু কোনটা না করেও বাসা থেকে বের হওয়া যায়?- ব্রেকফাস্ট! পরে খেয়ে নিব ‘একসময়’। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই ‘একসময়’ আর আসে না, আর তাই ব্রেকফাস্টও করা হয় না সময়মতো।
কিন্তু সকালের নাস্তায় অন্তত ২০ গ্রাম প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার থাকা অনেক জরুরি। ডিম একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার যা আমাদের ক্ষুধা নিবারণে অন্য যে কোনো খাদ্যশস্য থেকে উত্তম। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, সকালে একটি ডিম পরবর্তী ৩৬ ঘন্টায় আমাদের কম ক্ষুধার উদ্রেক করে, খাওয়ার পরিমাণ কমায় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। সকালের নাস্তায় একটি ডিম ৮ সপ্তাহে ৬৫% ওজন কমাতে সক্ষম।
খাওয়ার আধ ঘন্টা আগে, পানি পান করুন মনে করে
আমরা প্রায়ই তৃষ্ণা ও ক্ষুধাকে আলাদা করতে পারি না। এমনকি অনেককে খাবারের আগে পানি খেতে নিষেধ করতে দেখা যায়-ক্ষুধা চলে যাবে এই ধারণায়। কিন্তু আসল ঘটনাটা ভিন্ন। পানি ক্ষুধা মেটাতে পারে না। আমরা যখন তৃষ্ণার্ত থাকি, তখনই পানি আমাদের তৃপ্ত করে।
তাই এখন থেকে কোনো কিছু খেতে ইচ্ছা করলে তার কিছুক্ষণ আগে এক গ্লাস পানি খাবেন, দেখবেন এতে খাওয়ার পরিমাণ কমবে। পানি আমাদের দেহের মেটাবলিজম ১-১.৫ ঘন্টায় ২৪-৩০% করে বাড়ায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা খাওয়ার আধ ঘন্টা আগে পানি পান করেছে তাদের ওজন ৪৪% কমেছে কমেছে যারা পানি পান করেনি। পানি আমাদের ত্বক সুন্দর করে পাশাপাশি ক্লান্তি দূর করার মাধ্যমে দেহের সুস্থতা বজায় রাখে।
ছোট প্লেটে খান
অনেকে বলে- মানুষের মনের রাস্তা নাকি পেট দিয়ে যায়, পেট খুশি তো মনও খুশি! কিন্তু গবেষকদের উত্তর আলাদা। তারা বলেন, মন খুশি থাকলে নাকি পেটও খুশি থাকে। আর এই মনকে খুশি রাখতে আমরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারি।
গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট প্লেটে খেলে ওজন কমানো সহজ হয়। কেননা, বড় প্লেটে খাবার নিলে আমাদের অবচেতন মন ধরেই নেয় যে আমরা খাবার কম নিয়েছি। আর এটা ভেবেই প্লেটে আরো খাবার নিই। কিন্তু সেই একই পরিমাণ খাবার যদি আমরা ছোট প্লেটে নিই, তখন প্লেট ভরা থাকার কারণে মনে হয় অনেক খাচ্ছি। তাই আবার নেয়ার প্রবণতাটা কমে যায়। একবেলা খাবারের ক্যালরি যদি আমরা ৮০০ ধরে নেই, তাহলে প্লেটের এই পরিবর্তন বছরে ১০ পাউন্ড ওজন কমাতে সক্ষম।
ক্ষুধা পেলেই ফল খান
আধুনিকতার এই যুগে তো আমরা প্রায় সবকিছুই গুগলে খুঁজি। ওজন কমানোর পদ্ধতিগুলো সার্চ দিলেও আমরা খুঁজে পাবো কয়েক হাজার পদ্ধতি। প্রায় সবগুলোতেই ফল খাওয়ার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। সাত কিংবা দশ দিনের মতো স্বল্প সময়ে ওজন কমানোর যেসব আকর্ষণীয় উপায়গুলো দেখা যায়, সেগুলোও মূলত ফলের ওপরই নির্ভরশীল।
ফলের গুণগুলো কি আর বলে শেষ করা সম্ভব? একদিকে ফল যেমন পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও ক্ষুধা নিবারণে তৎপর, তেমনি ওজন হ্রাসেও রয়েছে এর বিশেষ ভূমিকা। অন্যান্য খাবারের তুলনায় ফলে ক্যালরি কম। পাশাপাশি বেশিরভাগ ফলই অতিরিক্ত ফ্যাট পোড়াতে সাহায্য করে যা দেহের মেটাবলিজম বাড়ায় এবং ওজন কমাতে সহায়ক। আপেল, তরমুজ, কমলা, আঙুর, পেয়ারার মত অতিপরিচিত ফলগুলোই ওজন কমাতে দারুণভাবে সহায়তা করে।
নিয়মিত হাঁটুন, সুস্থ থাকুন
বর্তমান সময়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল সকল দেশেই স্থূলতার সমস্যা বিরাজমান। ICDDRB এর রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশেও স্থূলতা ক্রমবর্ধমান। অতিরিক্ত ফাস্টফুড আসক্তির জন্য প্রাপ্তবয়ষ্কদের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
স্থূলতা রোধে হাঁটা একটি সহজ, দৈনন্দিন ও কার্যকর পদ্ধতি। সকাল কিংবা বিকালে কমপক্ষে আধা ঘন্টা হাঁটলে দেহের অতিরিক্ত ক্যালরি দহন করা সম্ভব। নিয়মিতভাবে ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটলে শরীরের প্রায় ১৫০ ক্যালরি দহন করা সম্ভব। হাঁটার গতি যত দ্রুত হবে, ওজন কমানো ততোটাই সহজ হবে।
আরও পড়ুনঃ হাঁটার অভ্যাসে জীবন বাড়ান ১১ বছর!
মানুষ সুন্দরের পূজারী। কে না চায় সৌন্দর্যের পাশাপাশি সুস্থ থাকতে? কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই অতিরিক্ত ওজন বাহ্যিক সৌন্দর্যে বাধা হিসেবে কাজ করে। কেননা স্বাস্থ্য রক্ষার্থে অতিরিক্ত ওজন হুমকিস্বরূপ। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু তা যেন কখনোই দেহের জন্য পীড়াদায়ক ও ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়- সেটা খেয়াল রাখতে হবে। কারণ মেটাবলিজম কমিয়ে নিজের ক্ষতি করে ওজন কমানো নেহায়েতই বোকামি। তাই সঠিকভাবে স্বাস্থ্যের খেয়াল রেখে ওজন কমাতে হবে। আর সেই উপায়গুলো তো বলেই দিলাম। এখন শুধু আপনার মেনে চলার পালা, তাই না?