সোমবার, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৫
HomeBusinessMoney Management৩০ বছরের আগে যে ৫টা Money Management টেকনিক শিখতেই হবে

৩০ বছরের আগে যে ৫টা Money Management টেকনিক শিখতেই হবে

মাসের ১ তারিখ। স্যালারি একাউন্টে এসেছে। মনে হচ্ছে এবার ঠিকঠাক চলবে। কিছু সেভ করব, একটু ঘুরতে যাব, হয়তো নতুন একটা কোর্সও কিনব। কিন্তু মাস যখন ১৫ তারিখে পৌঁছায়, তখন ব্যাংক ব্যালেন্সে তাকিয়ে মনে হয় “কোথায় গেল এত টাকা?”

এটা শুধু আপনার সমস্যা না। বাংলাদেশের হাজারো তরুণ-তরুণীর একই অবস্থা। মোবাইলে EMI, পরিবারকে কিছু পাঠানো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ফুডপান্ডায় অর্ডার, দারাজ থেকে শপিং—সব মিলিয়ে টাকা শেষ, মাস বাকি। আর পরের মাসও ঠিক একই গল্প।

কিন্তু এই চক্রটা ভাঙা যায়। আর তার জন্য দরকার একটু মাইন্ডসেট চেঞ্জ আর কিছু সিম্পল টেকনিক।

টাকা কম না—সিস্টেম নেই

বেশিরভাগ মানুষ মনে করে “আমার ইনকাম কম, তাই সেভ হয় না”। কিন্তু সত্যটা হলো, আপনার সমস্যা টাকার পরিমাণে না—সমস্যা সিস্টেমে।

অনেকে “বাজেট” শব্দটা শুনলেই ভয় পায়। মনে হয় বাজেট মানে নিজের জীবনকে খুব টাইট বেঁধে রাখা, কোনো মজা না করা। কিন্তু বাজেট আসলে restriction না, direction। এটা আপনার টাকাকে সঠিক জায়গায় পাঠানোর একটা ম্যাপ, যাতে আপনি মাস শেষে হাতে না নিয়ে চিন্তায় না পড়েন।

৩০ বছরের আগে যদি আপনি কিছু ব্যাসিক Money Management টেকনিক শিখে ফেলতে পারেন, তাহলে পরের দশকগুলো অনেক সহজ হয়ে যাবে। চলুন দেখি সেই পাঁচটা টেকনিক।

Technique #1: Pay Yourself First (নিজেকে আগে বাঁচান)

বেতন পাওয়ার পরে আমরা সবাই কি করি? প্রথমে বাসার ভাড়া, তারপর বিদ্যুৎ বিল, মোবাইল বিল, EMI—সব শেষে যদি কিছু থাকে তাহলে সেভ করার কথা ভাবি। কিন্তু শেষে প্রায়ই কিছু থাকে না।

এই টেকনিকে আপনি উল্টোটা করবেন। বেতন পেলেই সবার আগে নিজেকে “পেমেন্ট” দিবেন। মানে, আপনার সেভিংস বা ইনভেস্টমেন্ট একাউন্টে প্রথমেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ট্রান্সফার করে দিবেন।

কতটুকু? বাস্তবসম্মত হতে হবে। যদি আপনি ৫০,০০০ টাকা বেতন পান, তাহলে ৫-২০% দিয়ে শুরু করতে পারেন। মানে ২,৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকা। প্রথমে ছোট শুরু করুন, পরে বাড়াতে পারবেন।

ছোট টাস্ক: আপনার ব্যাংক অ্যাপে গিয়ে “Payday Auto Transfer” সেট করে দিন। বেতনের দিন অটোমেটিক যেন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সেভিংস একাউন্টে চলে যায়। এতে করে আপনি টাকা দেখবেনই না, খরচের টেম্পটেশনও আসবে না।

Technique #2: Money Tracking (টাকা কোথায় যাচ্ছে—চোখে দেখা)

আপনি জানেন না আপনার টাকা কোথায় যাচ্ছে, তাইলে সেটা কন্ট্রোল করবেন কীভাবে?

আপনার খরচকে তিন ভাগে ভাগ করুন:

Fixed Expenses (ফিক্সড): বাসা ভাড়া, ইন্টারনেট বিল, ইলেকট্রিসিটি—এগুলো প্রতি মাসে একই থাকে।

Variable Expenses (ভেরিয়েবল): খাবার, যাতায়াত, মেডিকেল—এগুলো মাসে মাসে কমবেশি হয়।

Leakage (ফুটো): অপ্রয়োজনীয় খরচ যেগুলো আসলে দরকার নেই কিন্তু হয়ে যায়।

বাংলাদেশের কনটেক্সটে Leakage কী হতে পারে? Pathao/Uber যেখানে বাসে যাওয়া যায়, foodpanda থেকে প্রায় রোজ খাওয়া, daraz থেকে impulse shopping, Netflix/Spotify/Amazon Prime একসাথে তিনটা সাবস্ক্রিপশন যার একটাও ঠিকমতো ব্যবহার হয় না।

৭ দিনের Expense Audit Challenge: আজ থেকে পরের সাত দিন প্রতিটা খরচ লিখে ফেলুন। মোবাইলে একটা নোট খুলুন বা কোনো সিম্পল অ্যাপ ব্যবহার করুন। ৫ টাকা রিকশা ভাড়া থেকে ৫০০ টাকার শপিং—সব লিখুন। সাত দিন পরে দেখবেন কোথায় টাকা গিয়ে ঢুকছে।

Technique #3: Lifestyle Inflation Control (ইনকাম বাড়লে খরচ যেন না বাড়ে)

চাকরিতে প্রমোশন হলো। স্যালারি ২০,০০০ টাকা বাড়ল। দারুণ, তাই না? কিন্তু পরের মাসেই নতুন মোবাইল, নতুন ব্র্যান্ডের জুতা, বন্ধুদের সাথে একটু বেশি খরচ করা—আর দেখবেন বেতন বাড়লেও সেভিংস বাড়েনি।

এটাকে বলে Lifestyle Inflation। আপনার ইনকাম বাড়ে, কিন্তু খরচও একইসাথে বাড়ে। ফলে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয় না।

“1st Raise Rule”: বেতন বৃদ্ধির অন্তত অর্ধেক (৫০%) সেভ বা ইনভেস্ট করুন। মানে ২০,০০০ টাকা বাড়লে ১০,০০০ টাকা আলাদা করে রাখুন, বাকি ১০,০০০ দিয়ে লাইফস্টাইল একটু আপগ্রেড করতে পারেন।

স্মার্ট লাইফস্টাইল: আপগ্রেড করুন “value”-তে, “show-off”-এ না। ভালো হেলথ চেকআপ, একটা ভালো বই কেনা, প্যারেন্টসদের কিছু দেওয়া—এগুলো value। কিন্তু শুধু দেখানোর জন্য ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট বা দামি গ্যাজেট কেনা show-off।

Technique #4: Emergency Fund = Financial Oxygen

চাকরি চলে গেল। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেন। পরিবারে কোনো ইমার্জেন্সি এসে গেল। এই মুহূর্তগুলোতে যদি হাতে টাকা না থাকে, তাহলে আপনাকে হয় লোন নিতে হবে, নয়তো ক্রেডিট কার্ডে ঢুকতে হবে।

Emergency Fund হলো আপনার ফিন্যান্সিয়াল অক্সিজেন। এটা এমন একটা ফান্ড যেখান থেকে জরুরি মুহূর্তে টাকা তুলতে পারবেন, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই।

কত টাকা রাখবেন? সাধারণ নিয়ম হলো তিন থেকে ছয় মাসের খরচ। মানে আপনার মাসিক খরচ যদি ৩০,০০০ টাকা হয়, তাহলে ৯০,০০০ থেকে ১,৮০,০০০ টাকার একটা Emergency Fund তৈরি করুন।

কোথায় রাখবেন? এমন জায়গায় যেখান থেকে দ্রুত তুলতে পারবেন। সেভিংস একাউন্ট, FDR (যেখানে প্রি-ম্যাচিউর উইথড্র অপশন আছে), বা লিকুইড মিউচুয়াল ফান্ড। শেয়ার মার্কেটে বা কোনো লক করা ইনভেস্টমেন্টে না।

টাস্ক: “Emergency Fund Ladder” একবারে বড় টার্গেট দেখলে ভয় লাগে। তাই ছোট ছোট ধাপে করুন। প্রথম লক্ষ্য ১ মাসের খরচ জমানো, তারপর ৩ মাস, তারপর ৬ মাস। ধীরে ধীরে এগোতে থাকুন।

Technique #5: Invest Early (সময় আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ)

অনেকে মনে করেন “আগে ভালো ইনকাম হোক, তারপর ইনভেস্ট করব”। কিন্তু এটা ভুল চিন্তা। কারণ ইনভেস্টমেন্টে সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সময়।

Investing মানে gambling না। এটা একটা habit এবং time-এর খেলা। আপনি যত তাড়াতাড়ি শুরু করবেন, আপনার টাকা তত বেশি সময় পাবে বাড়ার জন্য।

Beginner Options: বাংলাদেশে নতুনদের জন্য কিছু অপশন আছে—সেভিংস সার্টিফিকেট, মিউচুয়াল ফান্ড (যেমন ICB বা বিভিন্ন ব্যাংকের), DPS, অথবা খুব ছোট আকারে শেয়ার মার্কেটে শেখার জন্য। তবে যেটাই করবেন, আগে জেনে বুঝে করুন।

“Start Small” Principle: মাসে ৫০০ টাকা, ১,০০০ টাকা বা ২,০০০ টাকা দিয়েও ইনভেস্ট শুরু করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ হলো শুরু করা এবং নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া। ১০ বছর পরে দেখবেন সেই ছোট্ট টাকাগুলো মিলে একটা বড় ফান্ড হয়ে গেছে।

→ আরও পড়ুনঃ মধ্যবিত্তের টাকার সমস্যা—কারণ টাকা কম নয়, সিস্টেম ভুল!

৫ Techniques এর বাইরেও ৩ “Game-Changer” Mini Habits

শুধু এই পাঁচটা টেকনিকই যথেষ্ট না। কিছু ছোট ছোট habit আপনার ফিন্যান্সিয়াল জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে।

Debt Control: Credit Card/EMI Trap থেকে বের হওয়া

ক্রেডিট কার্ড বা EMI খুব সুবিধাজনক মনে হয়, কিন্তু এটা একটা trap। একবার ঢুকলে বের হওয়া কঠিন। যদি ইতিমধ্যে ঋণে থাকেন, তাহলে “Snowball Method” ব্যবহার করুন—ছোট ঋণগুলো আগে শোধ করুন, তারপর বড়গুলোতে যান। এতে motivation পাবেন এবং ধীরে ধীরে সব ক্লিয়ার হবে।

Subscription Detox: Unused Apps/OTT/Courses কেটে দিন

আপনার মোবাইলে কতগুলো subscription আছে যেগুলো আসলে ব্যবহার করেন না? Netflix দেখেন না কিন্তু পেমেন্ট যাচ্ছে। Spotify Premium নিয়েছেন কিন্তু YouTube ব্যবহার করেন বেশি। কোনো একটা online course কিনেছিলেন, দুইটা ভিডিও দেখেছেন, পরে আর ঢোকেননি। এই সবগুলো মিলে মাসে হয়তো ১,০০০-২,০০০ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। আজই একবার চেক করুন এবং অপ্রয়োজনীয়গুলো বন্ধ করে দিন।

“24-Hour Rule”: কোনো Impulse Purchase ২৪ ঘণ্টা পরে সিদ্ধান্ত

অনলাইনে কিছু দেখলেন, মনে হলো “এখনই কিনতে হবে”। কিন্তু একটু থামুন। এই impulse কে নিয়ন্ত্রণ করার একটা সহজ উপায় হলো ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করা। কার্টে রাখুন, পরের দিন দেখুন আসলেই দরকার কি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখবেন পরের দিন আর দরকার মনে হচ্ছে না।

One Simple System: 3-Bucket Budget (বাংলাদেশে কাজ করে এমন সহজ ফর্মুলা)

এত কিছু মনে রাখা কঠিন? চিন্তা নেই। একটা সিম্পল সিস্টেম ব্যবহার করুন: 3-Bucket Budget

আপনার আয়কে তিন ভাগে ভাগ করুন:

Bucket 1: Needs (দরকারি) — বাসা ভাড়া, খাবার, যাতায়াত, বিল—যেগুলো ছাড়া চলবে না। এতে আপনার আয়ের ৫০-৬০% রাখুন।

Bucket 2: Future You (ভবিষ্যতের জন্য) — Savings, Emergency Fund, Investment—এগুলো আপনার ভবিষ্যতের নিরাপত্তা। এতে ২০-৩০% রাখুন।

Bucket 3: Life (জীবন উপভোগ) — মজা করা, উপহার কেনা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, শখের কাজ—এগুলো ছাড়া জীবনটা নিষ্প্রাণ। এতে ২০-৩০% রাখুন।

Practical Tip: আপনার ইনকাম যত কমই হোক, এই তিন bucket percentage হিসেবে ভাগ করুন। ২০,০০০ টাকা হোক বা ৫০,০০০ টাকা—সিস্টেম একই থাকবে।

টাকা জীবন ঠিক করে না—সিস্টেম জীবন সহজ করে

শেষ কথা হলো, টাকা থাকলেই জীবন সুখের হয় না। কিন্তু একটা ভালো financial system থাকলে জীবন অনেক সহজ হয়। রাতে ভালো ঘুম হয়। কোনো ইমার্জেন্সি এলে ঘাবড়ে যেতে হয় না।

৩০ বছরের আগে আপনার লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? বড়লোক হওয়া না। লক্ষ্য হওয়া উচিত:

  • Debt কমানো বা একদম শেষ করা
  • একটা ভালো Emergency Fund তৈরি করা
  • Money management এর habit তৈরি করা

এই তিনটা জিনিস যদি করতে পারেন, তাহলে পরের দশকগুলো অনেক শান্তিতে কাটবে।

আজ থেকেই শুরু করুন: ৭ দিনের ট্র্যাকিং চ্যালেঞ্জ এবং ২১ দিনের পে-ইয়োরসেলফ-ফার্স্ট চ্যালেঞ্জ। কাগজে বা মোবাইলে লিখে রাখুন এবং follow করুন।

এখন আপনার পালা: একটু ভাবুন তো, আপনার সবচেয়ে বড় money leakage কোনটা? কোন জায়গায় টাকা যাচ্ছে যেটা আসলে দরকার নেই? কমেন্টে জানান। হয়তো আপনার অভিজ্ঞতা থেকে অন্যরাও শিখতে পারবে।

মনে রাখবেন, financial freedom রাতারাতি আসে না। কিন্তু ছোট ছোট পদক্ষেপ, নিয়মিত habit—এগুলো মিলে একসময় বিরাট পরিবর্তন আনে। আর সেই পরিবর্তনের শুরুটা হোক আজ থেকেই।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular