back to top
বুধবার, অক্টোবর ২২, ২০২৫
HomeInspirationYouth Achieverব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলভি এখন মেটা সিঙ্গাপুরে মার্কেট স্পেশালিস্ট: Facebook-Instagram-এর মূল কোম্পানিতে বাংলাদেশি

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলভি এখন মেটা সিঙ্গাপুরে মার্কেট স্পেশালিস্ট: Facebook-Instagram-এর মূল কোম্পানিতে বাংলাদেশি

২০১৮ সালের এক সকালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে বসে আলভি হয়তো কল্পনাও করেননি যে কয়েক বছর পরে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী টেক কোম্পানিগুলোর একটিতে কাজ করবেন। আজ ২০২৫ সালে, বিএম মোস্তফা মাহমুদ আলভি যোগ দিয়েছেন Meta Singapore-এ ‘Market Specialist in Global Response Operations’ হিসেবে। Facebook, Instagram, WhatsApp—এই তিন প্ল্যাটফর্মের প্যারেন্ট কোম্পানি মেটায় এখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন একজন ঢাকার তরুণ।

কিন্তু এটা শুধু একটা চাকরির গল্প নয়। এটা একটা স্বপ্নপূরণের গল্প, একটা দেশের সম্ভাবনার গল্প, এবং সবচেয়ে বড় কথা—এটা প্রমাণ যে সঠিক শিক্ষা এবং প্রস্তুতি থাকলে বাংলাদেশ থেকে Silicon Valley-র দরজা খোলা যায়। চলুন জানি কীভাবে একজন বাংলাদেশি আইনজীবী পৌঁছালেন প্রযুক্তি জগতের শীর্ষে।

মেটা কী এবং কেন এটা এতো গুরুত্বপূর্ণ?

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা কী করি? হয়তো Facebook খুলি, Instagram-এ স্টোরি দেখি, বা WhatsApp-এ মেসেজ পাঠাই। কিন্তু জানেন কি, এই তিনটি প্ল্যাটফর্ম একই কোম্পানির মালিকানায়? সেটা হলো মেটা—মার্ক জাকারবার্গের তৈরি টেক জায়ান্ট, যেটা আগে Facebook Inc. নামে পরিচিত ছিল।

শুধু বাংলাদেশেই Facebook-এর ব্যবহারকারী প্রায় ৫ কোটি, Instagram ব্যবহার করেন প্রায় ২ কোটি মানুষ, আর WhatsApp? প্রায় প্রতিটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর ফোনেই আছে এটা। মোট কথা, মেটার প্ল্যাটফর্মগুলো এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বিশ্বব্যাপী মেটার প্রায় ৩ বিলিয়ন ব্যবহারকারী। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের অভিজ্ঞতা নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন করতে দরকার হাজারো পেশাদারের—ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনার, পলিসি মেকার, এবং অবশ্যই Market Specialist-দের মতো মানুষ যারা স্থানীয় প্রেক্ষাপট বোঝেন।

আর এখানেই আলভির ভূমিকা অনন্য হয়ে ওঠে।

Global Response Operations: যেখানে প্রতিটি সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ

আলভি এখন যে টিমে কাজ করবেন, সেটা মেটার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ—Global Response Operations। এই টিমের দায়িত্ব হলো রিয়েল-টাইমে সংকট মোকাবেলা করা, ঝুঁকিপূর্ণ কন্টেন্ট চিহ্নিত করা এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।

কল্পনা করুন: বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনের সময় ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ছে Facebook-এ, বা Instagram-এ হঠাৎ করে কোনো বিভ্রান্তিকর ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন? কোন কন্টেন্ট সরানো হবে, কোনটা থাকবে? কীভাবে নিশ্চিত করবেন যে বাক স্বাধীনতা রক্ষা করার পাশাপাশি ক্ষতিকর তথ্য ছড়ানো রোধ হচ্ছে?

এই জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হয় Global Response Operations টিমকে। আলভির মতো Market Specialist-রা এখানে কাজ করেন Policy, Legal, Product এবং Operations টিমের সাথে মিলে। তাদের কাজ শুধু কন্টেন্ট রিভিউ করা নয়, বরং স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।

বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ভাষাগত সূক্ষ্মতা আছে, আঞ্চলিক বৈচিত্র্য আছে, এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—সেখানে আলভির মতো স্থানীয় বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি অমূল্য। তিনি শুধু একজন কর্মচারী নন, বরং ১৮ কোটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর কণ্ঠস্বর হবেন মেটার গ্লোবাল টেবিলে।

BLAST থেকে Banglalink, তারপর Meta: একটি অসাধারণ যাত্রাপথ

আলভির ক্যারিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল একেবারে তৃণমূল থেকে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ল থেকে স্নাতক শেষ করে তিনি যোগ দেন BLAST (Bangladesh Legal Aid and Services Trust)-এ। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনি সহায়তা প্রদানে অগ্রণী।

BLAST-এ কাজ করার অভিজ্ঞতা আলভিকে শিখিয়েছিল মানুষের সমস্যা গভীরভাবে বুঝতে, জটিল আইনি বিষয় সহজ করতে, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য লড়তে। প্রতিদিন তিনি দেখতেন কীভাবে আইনের সঠিক প্রয়োগ মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, কীভাবে নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে সেতু তৈরি করতে হয়।

এরপরের ধাপ ছিল Banglalink-এ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স। একটি টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্টে কাজ করতে গিয়ে আলভি হাতেকলমে শিখলেন ডেটা প্রাইভেসি, নিয়ন্ত্রক সম্মতি (regulatory compliance), কর্পোরেট নীতি প্রণয়ন, এবং সরকার-ব্যবসা-গ্রাহকদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। Banglalink-এর মতো কোম্পানিতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ গ্রাহকের ডেটা পরিচালনা করা হয়—এখানে ছোট্ট একটা ভুল মানে বড় সমস্যা।

এই দুটি ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা—একদিকে মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার, অন্যদিকে কর্পোরেট নীতি ও প্রযুক্তি—আলভিকে তৈরি করেছে মেটার মতো গ্লোবাল টেক কোম্পানির জন্য আদর্শ প্রার্থী হিসেবে।

কেন আইনজীবীদের দরকার টেক কোম্পানিতে?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, টেক কোম্পানিতে তো ইঞ্জিনিয়ার আর ডেভেলপার লাগে। একজন আইনজীবী সেখানে কী করবেন?

উত্তরটা আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক টেক কোম্পানিগুলো এখন শুধু সফটওয়্যার তৈরি করে না, তারা সমাজ পরিচালনা করে। Facebook-Instagram-এর মাধ্যমে মতামত তৈরি হয়, আন্দোলন সংগঠিত হয়, নির্বাচন প্রভাবিত হয়, ব্যবসা চলে। এই বিশাল দায়িত্বের সাথে আসে জটিল চ্যালেঞ্জ:

কন্টেন্ট মডারেশন: কোন পোস্ট থাকবে, কোনটা সরানো হবে? বাক স্বাধীনতা এবং ক্ষতি প্রতিরোধের মধ্যে ভারসাম্য কোথায়?

ডেটা প্রাইভেসি: ব্যবহারকারীদের তথ্য কীভাবে সংরক্ষণ এবং ব্যবহার করা হবে? GDPR, স্থানীয় আইন—সব মেনে চলতে হবে।

সাইবার নিরাপত্তা: Deepfake, misinformation, hate speech—এসব কীভাবে চিহ্নিত এবং প্রতিরোধ করা যায়?

নৈতিক দায়বদ্ধতা: AI অ্যালগরিদম কি পক্ষপাতদুষ্ট? সংখ্যালঘুদের অধিকার কি রক্ষিত হচ্ছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দরকার আইনি জ্ঞান, নৈতিক বোধ, এবং সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া। আলভির মতো আইনজীবীরা এখানে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন। তারা নিশ্চিত করেন যে প্রযুক্তি মানুষের সেবায় কাজ করছে, ক্ষতি করছে না।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়: গ্লোবাল লিডার তৈরির কারখানা

আলভির সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত প্রতিভার ফল নয়—এটা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যও। এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক তৈরি করেছে।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ল শুধু আইনের বই পড়ায় না। এখানে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় কীভাবে critical thinking করতে হয়, কীভাবে বাস্তব সমস্যা সমাধান করতে হয়, এবং কীভাবে আইন, প্রযুক্তি ও নৈতিকতার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়।

মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ইন্ডাস্ট্রি এক্সপোজার, research opportunity—সবকিছু মিলে তৈরি হয় এমন গ্র্যাজুয়েট যারা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বমঞ্চেও প্রতিযোগিতা করতে পারেন।

শুধু আলভি নন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর এমন স্নাতক বের হচ্ছেন যারা আন্তর্জাতিক সংস্থা, বহুজাতিক কোম্পানি, এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন। এটা একটা ট্রেন্ড হয়ে উঠছে—বাংলাদেশি শিক্ষার মান যে বিশ্বমানের, তার প্রমাণ।

বাংলাদেশের জন্য কী মানে এই সাফল্য?

আলভির মেটায় যোগদান শুধু একটি চাকরির খবর নয়—এটা বাংলাদেশের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। এর তাৎপর্য কয়েকটি স্তরে:

প্রথমত, প্রতিনিধিত্ব: বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ Facebook, Instagram, WhatsApp ব্যবহার করেন। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সমস্যা এখন সরাসরি মেটার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধিত্ব পাবে। যখন বাংলাদেশ-সংক্রান্ত কোনো পলিসি তৈরি হবে, সেখানে থাকবে আমাদের নিজেদের মানুষ।

দ্বিতীয়ত, সেবার মান: স্থানীয় বিশেষজ্ঞ থাকার মানে হলো বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের অভিযোগ এবং সমস্যা আরও দ্রুত, আরও কার্যকরভাবে সমাধান হবে। ভাষার সূক্ষ্মতা, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট—সব বিবেচনায় আসবে সিদ্ধান্তে।

তৃতীয়ত, অনুপ্রেরণা: বাংলাদেশি তরুণদের জন্য এটা একটা শক্তিশালী বার্তা—”তুমিও পারবে”। সিঙ্গাপুর, লন্ডন, সিলিকন ভ্যালি—সবখানেই বাংলাদেশিদের জায়গা আছে, যদি তারা যথেষ্ট প্রস্তুত থাকেন।

চতুর্থত, ডিজিটাল সমতা: টেক কোম্পানিগুলোতে বৈচিত্র্য (diversity) এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি, ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ থাকলে পণ্য ও সেবা সবার জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) হয়। আলভির উপস্থিতি এই বৈচিত্র্যে অবদান রাখবে।

তরুণদের জন্য শিক্ষা: আলভির পথ অনুসরণ

আলভির যাত্রা থেকে বাংলাদেশি তরুণরা কী শিখতে পারেন?

১. বহুমুখী দক্ষতা অর্জন করুন: আলভি শুধু আইনজীবী নন। তিনি বোঝেন মানবাধিকার, কর্পোরেট নীতি, প্রযুক্তি, এবং গ্লোবাল অপারেশন। একাধিক ক্ষেত্রে দক্ষতা আপনাকে অনন্য করে তুলবে।

২. অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য: BLAST-এ advocacy, Banglalink-এ corporate—প্রতিটি অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করলে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রশস্ত হয়।

৩. টেক এবং আইনের সংযোগ বুঝুন: আগামীর সবচেয়ে বড় সুযোগ আছে যেখানে প্রযুক্তি এবং আইন মিলিত হয়। Cyber law, data privacy, AI ethics—এসব ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার বিশাল।

৪. নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিন: টেক কোম্পানিগুলো এখন এমন মানুষ চায় যারা শুধু দক্ষ নয়, বরং ethical leadership দিতে পারেন।

৫. ইংরেজি এবং কমিউনিকেশন স্কিল: গ্লোবাল কোম্পানিতে কাজ করতে চাইলে fluent English এবং effective communication অপরিহার্য।

৬. নেটওয়ার্কিং: লিঙ্কডইনে সক্রিয় থাকুন, ইন্ডাস্ট্রি ইভেন্টে যান, মেন্টর খুঁজুন। সঠিক মানুষদের সাথে সংযোগ আপনার ক্যারিয়ার বদলে দিতে পারে।

যখন আলভি Meta Singapore-এর অফিসে প্রথম দিন প্রবেশ করবেন, তিনি হয়তো একটু nervous বোধ করবেন। নতুন পরিবেশ, নতুন সহকর্মী, নতুন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তার ব্যাগে থাকবে বাংলাদেশের শিক্ষা, BLAST-এর অভিজ্ঞতা, Banglalink-এর শিক্ষা, এবং ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশা।

তার সাফল্য প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ আর শুধু গার্মেন্টস বা রেমিট্যান্সের দেশ নয়। আমরা এখন গ্লোবাল টেক ইন্ডাস্ট্রিতেও নেতৃত্ব দিতে পারি। আমাদের তরুণদের প্রতিভা, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান—সব বিশ্বমানের।

আজ Meta, কাল Google, পরশু Microsoft। বাংলাদেশি তরুণদের এই যাত্রা থামবে না। প্রতিটি সাফল্যের গল্প পথ তৈরি করছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আলভির গল্প শেষ নয়, এটা শুরু—একটা নতুন যুগের, যেখানে বাংলাদেশি পেশাদাররা বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

তাই যদি আপনি একজন তরুণ হন, স্বপ্ন দেখছেন বড় কিছু করার—তাহলে আলভির গল্প আপনার জন্য। প্রস্তুতি নিন, দক্ষতা অর্জন করুন, নেটওয়ার্ক তৈরি করুন। কারণ পরবর্তী গল্পটা হতে পারে আপনার।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular