জাহিদ সবুরের জীবনযাত্রা এক অনুপ্রেরণামূলক গল্প, যা শুরু হয়েছিল সৌদি আরবের এক শিক্ষাবিদ পরিবারে। তাঁর পিতা কিং ফয়সাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আট বছর বয়সে জাহিদ তাঁর পরিবারের সাথে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং পটুয়াখালী জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর তড়িৎ প্রকৌশলের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই তিনি মায়ের সহায়তায় বর্তনী চিত্র আঁকতেন এবং ইলেকট্রনিক বর্তনী তৈরি করতেন। তাঁর মা, লুৎফুন্নেসা বেগম, কেবল তাঁকে উৎসাহিতই করেননি, বরং প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক সরঞ্জামও কিনে দিতেন। এই আগ্রহের বীজই সম্ভবত ভবিষ্যতের একজন সফল প্রকৌশলীকে জন্ম দিয়েছিল। বাংলাদেশে থাকাকালীন তিনি মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করেন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অর্জিত জ্ঞান তাঁর ভবিষ্যতের সাফল্যের ভিত্তি স্থাপন করে।
বাংলাদেশে শিক্ষা: সাফল্যের ভিত্তি
জাহিদ সবুরের সাফল্যের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪.০ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক হন তিনি। এই কৃতিত্ব প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এআইইউবিতে অধ্যয়নকালে তিনি বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন, যা তাঁর বিশ্লেষণাত্মক এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি অনলাইন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায়ও দক্ষতা দেখিয়েছেন এবং স্পেনের ভ্যালাডোলিড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্ল্যাটফর্মে উচ্চ স্থান অর্জন করেছেন। এআইইউবিতে অনুষ্ঠিত এমনই একটি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে গুগল প্রতিনিধিদের দ্বারা অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এর এক মাসের মধ্যেই তিনি গুগলের কাছ থেকে চাকরির প্রস্তাব পান। জাহিদ সবুরই ছিলেন প্রথম কোনো বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যিনি সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে গুগলে যোগদান করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক যাত্রা: কর্মজীবনের মাইলফলক এবং প্রতিবন্ধকতা
২০০৭ সালে জাহিদ সবুরের আন্তর্জাতিক কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে ভারতের ব্যাঙ্গালোরে গুগলের ব্যাকেন্ড সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে যোগদান করেন। মাত্র ছয় মাস পরেই তিনি গুগলের ক্যালিফোর্নিয়ার অফিসে স্থানান্তরিত হন। তাঁর কর্মজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক আসে ২০১৯ সালের মে মাসে, যখন তিনি গুগলের জুরিখ অফিসে প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিরেক্টর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়া প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তিনি দেশের জন্য এক অনন্য সম্মান বয়ে আনেন। গুগলে যোগদানের প্রথম দিনগুলো তাঁর জন্য বেশ কঠিন ছিল। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া এবং নিজের সক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখাটা জরুরি ছিল। সময়ের সাথে সাথে তাঁর একাগ্রতা ও কঠোর পরিশ্রম তাঁকে গুগলের উচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। বর্তমানে তাঁর দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে নতুন ও উদ্ভাবনী ধারণা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা, কর্মী নিয়োগ, দল গঠন এবং এমন একটি কর্মপরিবেশ তৈরি করা যেখানে সবাই সম্মিলিতভাবে অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে উৎসাহিত হয়।
গুগলে অবদান: উদ্ভাবন এবং প্রভাব
গুগলে জাহিদ সবুরের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রথম গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্মার্ট ডিসপ্লে-এর ইঞ্জিনিয়ারিং দলের নেতৃত্ব দেন, যা সিইএস-এ ২০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করে এবং গণমাধ্যমে ইতিবাচক সাড়া ফেলে। বর্তমানে তিনি নেক্সট জেনারেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়েও কাজ করছেন। তাঁর সবচেয়ে সাম্প্রতিক এবং উল্লেখযোগ্য কাজ হলো গুগলের জেমিনি অ্যাপ (পূর্বে বার্ড)-এর ইঞ্জিনিয়ারিং দলের নেতৃত্ব দেওয়া। এই অ্যাপটি তৈরি করতে পেরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে গর্বিত। উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার স্বীকৃতিস্বরূপ জাহিদ সবুর বেশ কয়েকটি পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় সহকারীদের জন্য সক্রিয় ক্যাশিং, কথোপকথনে অপ্রত্যাশিত আগ্রহের বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা, স্বয়ংক্রিয় সহকারীদের মাধ্যমে অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্সেস করা এবং অডিও ও ভিডিও কলের সময় সহায়তা প্রদান। তিনি অডিও এবং ভিডিও কলের সময় সহায়তার জন্য ১২০২৮৩০২ নম্বর পেটেন্টের একজন উদ্ভাবক। এই উদ্ভাবনগুলো গুগলের প্রযুক্তিকে আরও উন্নত ও ব্যবহারকারী-বান্ধব করতে সহায়ক।
বৈশ্বিক স্বীকৃতি: বাংলাদেশের জন্য গৌরব
জাহিদ সবুর কেবল গুগলেই একজন সফল ব্যক্তিত্ব নন, বিশ্ব মঞ্চেও তিনি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী যিনি গুগলের ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সম্প্রতি, সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত Xiaomi-এর বিশ্বব্যাপী লঞ্চ ইভেন্টে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন, যেখানে Xiaomi 14T সিরিজের উন্মোচন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি শিল্পে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং বাংলাদেশকে তুলে ধরে । তাঁর প্রাক্তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এআইইউবি তাঁকে একজন বিশিষ্ট প্রকৌশলী, গুগলের সিনিয়র ডিরেক্টর এবং তাদের গর্বিত প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি “সিক্রেটস টু সাকসেস” শিরোনামে একটি বক্তৃতা সিরিজের আয়োজন করে, যেখানে জাহিদ তাঁর সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে অনুষ্ঠিত এআইইউবিয়ান ইউরোপ মিটআপ ২০২৪-এ তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নেটওয়ার্কের গুরুত্বের উপর জোর দেন। বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যম যেমন দ্য ডেইলি স্টার এবং ঢাকা ট্রিবিউন তাঁকে “প্রথম বাংলাদেশী প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার” এবং “গুগলের জেমিনি অ্যাপের পেছনের বাংলাদেশী মস্তিষ্ক” হিসেবে উদযাপন করেছে । এই স্বীকৃতিগুলো প্রমাণ করে যে তাঁর অর্জন কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতীয় গর্বের বিষয়।
প্রেরণা ও ভবিষ্যৎ: জাহিদ সবুরের দৃষ্টিকোণ
জাহিদ সবুর মনে করেন যে নিজের সফলতাই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে। তিনি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সাথে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার জন্য আগ্রহী। তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি মুখস্থ করার পরিবর্তে বুঝে শেখার গুরুত্বের উপর জোর দেন। তাঁর মতে, জীবনে দয়ালু ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া, জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া এবং যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকা অপরিহার্য। জাহিদ নিজেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ফসল হিসেবে দেখেন এবং বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। এমনকি তিনি দাবি করেন যে বাংলাদেশের ছাত্র হিসেবে তিনি অনেক জটিল বিষয় অধ্যয়ন করেছেন এবং বিদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক স্নাতকের চেয়ে কঠিন সমস্যা সমাধান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে তিনি প্রোগ্রামিং শুরু করেন এবং প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা তাঁর বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল । বর্তমানে গুগলে তাঁর দায়িত্ব অনেকটা ব্যবসা পরিচালনার মতো, যেখানে নতুন ধারণা উদ্ভাবন, মেধাবী কর্মী নিয়োগ এবং দল গঠনের মতো কাজগুলো অন্তর্ভুক্ত । তিনি সেইসব দিনের কথা স্মরণ করেন যখন তিনি একটি “স্বল্পোন্নত দেশ” থেকে উঠে এসে কেবল কঠোর পরিশ্রম ও সততার মাধ্যমে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন এবং এই যাত্রাকেই তিনি সবচেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করেন ।
জাহিদ সবুরের জীবনযাত্রা বাংলাদেশের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সৌদি আরবে জন্ম নেওয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে বেড়ে ওঠা এবং পরবর্তীতে গুগলের মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে আসীন হওয়া—এই পথ মোটেই সহজ ছিল না। তাঁর কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা তাঁকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। প্রথম বাংলাদেশী প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিরেক্টর হিসেবে তিনি কেবল নিজের জন্যই সম্মান অর্জন করেননি, বরং বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের নামও উজ্জ্বল করেছেন। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্মার্ট ডিসপ্লে এবং জেমিনি অ্যাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে তাঁর নেতৃত্ব এবং অবদান প্রযুক্তি বিশ্বে বিশেষভাবে সমাদৃত। জাহিদ সবুরের গল্প সেইসব তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা, যারা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে চান। তাঁর বার্তা—কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখলে যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। জাহিদ সবুর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর আলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে।