সকাল ৯টা পেরিয়ে গেছে। অফিসে যাওয়ার তাড়া, ট্রাফিকের চিন্তা—নাশতা এখনও বাকি। অনেকের কাছেই এটা রোজকার চিত্র। কিন্তু এই সাধারণ অভ্যাসটা কি আসলেই আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর? নাকি এটা শুধুই আরেকটা ভাইরাল ফিটনেস টিপ?
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে ভিন্ন কথা। দেরিতে প্রথম খাবার খাওয়ার সাথে হৃদরোগের ঝুঁকির সম্পর্ক পাওয়া গেছে। আসুন দেখি এর পেছনে আসল বিজ্ঞানটা কী।
শরীরের ‘বডি ক্লক’ কেন খাবারের সময়কে গুরুত্ব দেয়
আমাদের শরীরে একটি অভ্যন্তরীণ ঘড়ি কাজ করে, যাকে বলা হয় সার্কাডিয়ান রিদম। এই জৈবিক ঘড়ি আমাদের হরমোন নিঃসরণ, মেটাবলিজম এবং ঘুম-জাগরণের চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। দিন-রাতের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শরীর কাজ করে—আর খাবারের সময় এই তালকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সকালবেলা আমাদের শরীর তুলনামূলকভাবে বেশি ইনসুলিন-সেনসিটিভ থাকে। মানে হলো, সকালে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা সাধারণত ভালো থাকে। তাই অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দেরি করে খাওয়া শুরু করলে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মেটাবলিক চাপ বাড়তে পারে।
গবেষণায় কী পাওয়া গেছে
ফ্রান্সের বড় পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা NutriNet-Santé-তে দেখা গেছে, যারা সকাল ৯টার পরে প্রথম খাবার খান, তাদের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বেশি। তবে এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার—এটা সরাসরি কারণ প্রমাণ করে না, বরং একটি সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। বড় ডেটাসেটে এই ধারাবাহিক সিগন্যাল অবশ্যই মনোযোগের দাবি রাখে।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, খুব ভোরে নাশতা করার সাথে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমার সম্ভাব্য সম্পর্ক আছে। ক্রোনোনিউট্রিশন বা খাবারের সময়ভিত্তিক পুষ্টিবিজ্ঞানের গবেষকরা এই বিষয়টি নিয়ে আরও কাজ করছেন।
‘৯টা’ কি ম্যাজিক নাম্বার?
সংক্ষিপ্ত উত্তর: না। আসল বিষয়টা আরেকটু জটিল।
আসল ফ্যাক্টর ১: আপনার ঘুম থেকে ওঠার সময়
কেউ যদি সকাল ১১টায় ঘুম থেকে ওঠেন, তার জন্য সকাল ৯টার আগে নাশতা করা তো অসম্ভব। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘুম থেকে ওঠার এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে প্রথম খাবার খাওয়া বেশি বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর।
আসল ফ্যাক্টর ২: রাতের খাবার কখন খাচ্ছেন
খুব দেরিতে রাতের খাবার এবং দেরিতে নাশতা—এই দুইয়ের সমন্বয় শরীরের জৈবিক ছন্দকে দীর্ঘসময় ধরে বিঘ্নিত করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রাত ১১টার পর ভারী খাবার খেয়ে পরদিন দেরিতে নাশতা করলে শরীরের মেটাবলিক সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
আসল ফ্যাক্টর ৩: খাবারের মান এবং মোট ক্যালরি
নাশতা সকাল সাড়ে ৯টায় হলেও যদি খাবারটি পুষ্টিকর হয় এবং রাতের খাবার খুব ভারী না হয়, তাহলে ঝুঁকির মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। শুধু সময় নয়, কী খাচ্ছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
দেরিতে নাশতা করলে কী সমস্যা হতে পারে
দেরিতে নাশতা করার সম্ভাব্য প্রভাবগুলো হলো:
ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা: সকালে খাবার এড়িয়ে গেলে দুপুর বা রাতে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। শরীর ক্ষুধা হরমোনগুলো ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
রক্তে শর্করার ওঠানামা: দীর্ঘসময় খালি পেটে থাকার পর হঠাৎ খাবার খেলে ব্লাড সুগার দ্রুত বাড়ে এবং কমে, ফলে এনার্জি ক্র্যাশ হয়।
ঘুমের গুণমান খারাপ হওয়া: যদি রাতেও খাবার দেরি হয়, তাহলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, যা পরের দিন আবার একই চক্র তৈরি করে।
দীর্ঘমেয়াদে হৃদ্স্বাস্থ্যে প্রভাব: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অনিয়মিত খাবারের সময় দীর্ঘমেয়াদে ওজন বৃদ্ধি এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
কারা বেশি সতর্ক থাকবেন
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে এই গ্রুপগুলোর মানুষদের খাবারের সময় নিয়ে সচেতন থাকা উচিত:
- ডায়াবেটিস বা প্রিডায়াবেটিস রোগীরা: এদের ক্ষেত্রে খাবারের সময় রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে।
- উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা: এদের জন্য নিয়মিত খাবারের রুটিন আরও জরুরি।
- রাতে দেরি করে খাওয়ার অভ্যাস যাদের: বিশেষ করে যারা রাত ১১টার পরও ভারী খাবার খান।
- কাজের চাপে ‘দিনে কিছু না, রাতে বেশি’ প্যাটার্ন যাদের: এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক ক্ষতিকর।
কারা ‘৯টার পরে নাশতা’ করলেও সমস্যায় পড়বেন না
সবার জন্য এই নিয়ম এক নয়:
শিফট ওয়ার্কার বা নাইট শিফটে কাজ করেন যারা: এদের বডি ক্লক ভিন্ন, তাই খাবারের সময়ও ভিন্ন হবে।
যারা দেরিতে ওঠেন কিন্তু নিয়মিত রুটিন মেনে চলেন: যদি খাবারের উইন্ডো নিয়মিত থাকে এবং রাতের খাবার খুব দেরি না হয়, তাহলে সমস্যা কম।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করেন যারা: তবে ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো রোগ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে।
বাস্তবসম্মত সমাধান: কাল থেকেই শুরু করুন
‘৯টার নিয়ম’ নয়—’রুটিনের নিয়ম’
প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে প্রথম খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। রাতের খাবার তুলনামূলক আগে শেষ করার অভ্যাস করুন। এটাই আসল চাবিকাঠি।
ব্যস্ত মানুষের ‘মাইক্রো-ব্রেকফাস্ট’
মাত্র ৫ মিনিটে পুষ্টিকর নাশতা সম্ভব। যেমন:
- সেদ্ধ ডিম + একটি কলা
- দই + বাদাম + মধু
- ওটস + দুধ + ফল
- পাউরুটি + পিনাট বাটার
মূল ফোকাস: প্রোটিন এবং ফাইবার যুক্ত খাবার।
৩টি সহজ চেকলিস্ট
নিজেকে প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করুন:
১. আমি কি রাত সাড়ে ১০টা বা ১১টার পরও ভারী খাবার খাই? ২. আমি কি সকালটা শুধু কফি দিয়ে চালাই, তারপর দুপুরে অতিরিক্ত ক্ষুধা অনুভব করি? ৩. আমি কি দুপুরের পর ঘুমঘুম ভাব বা এনার্জি ক্র্যাশ অনুভব করি?
যদি এর যেকোনো একটির উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে আপনার খাবারের সময়সূচী পরিবর্তন দরকার।
শেষ কথা
‘৯টা’ একা কোনো ম্যাজিক নাম্বার নয়—তবে বড় গবেষণাগুলো দেখাচ্ছে যে দেরিতে প্রথম খাবার খাওয়া হৃদ্স্বাস্থ্যের ঝুঁকির সাথে যুক্ত হতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনার ঘুম এবং খাবারের সময় একসাথে সঠিকভাবে সেট করা। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মিল টাইমিং গাইডলাইনও এই একই কথা বলে।
মনে রাখবেন, লক্ষ্য পারফেক্ট হওয়া নয়—কনসিস্টেন্ট হওয়া। ছোট ছোট পরিবর্তন দিয়ে শুরু করুন। আপনার শরীর নিজেই পার্থক্যটা বুঝিয়ে দেবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই তথ্যগুলো সাধারণ সচেতনতার জন্য। কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

