ওজন কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ, কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন—সেটাই আসল প্রশ্ন।
জিমে গেলেই দেখবেন কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ হাঁটছে, কেউ আবার বলছে—“দৌড়ালে বেশি ফ্যাট বার্ন হয়।”
আবার অন্য কেউ বলছে—“হাঁটলে সেফ, সাস্টেইনেবল, জোড়ায় চাপ কম!”
আপনি হয়তো ভাবছেন—
“আমার জন্য কোনটা ভালো? হাঁটা নাকি দৌড়ানো?”
এই প্রশ্নটা অনেকেরই।
বিশেষ করে যারা নতুনভাবে ফিটনেস শুরু করতে চান, বা অফিস শেষে জিমে গিয়ে কিছুক্ষণ ট্রেডমিল করতে চান—কিন্তু কীভাবে করলে বেশি ক্যালোরি বার্ন হবে, শরীরের ক্ষতি হবে না, আর ফলও মিলবে—তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন।
চলুন, গবেষণা, বিশেষজ্ঞ মতামত এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানি—
ওজন কমানোর জন্য ট্রেডমিলে হাঁটা এবং দৌড়ানো—কোনটা আপনার জন্য বেশি কাজে আসবে।
ক্যালোরি বার্নিং: সংখ্যায় কে এগিয়ে?
সোজা উত্তর – একই সময়ের জন্য তুলনা করলে দৌড়ানো হাঁটার চেয়ে বেশি ক্যালোরি বার্ন করে। একজন ৬৮ কেজি ওজনের মানুষের ক্ষেত্রে:
৩০ মিনিট দৌড়ানো: ৩০০-৪০০ ক্যালোরি
৩০ মিনিট হাঁটা: ১৫০-২০০ ক্যালোরি
৩০ মিনিট ইনক্লাইনে হাঁটা: ২৫০-৩৫০ ক্যালোরি
এক পাউন্ড ওজন কমাতে প্রায় ৩,৫০০ ক্যালোরি পোড়াতে হয়। তাই যদি আপনার সময় কম থাকে এবং দ্রুত ক্যালোরি বার্ন করতে চান, দৌড়ানো একটি শক্তিশালী অপশন। এক ঘন্টা দৌড়ে ৫০০-৭০০ ক্যালোরি পর্যন্ত পোড়ানো সম্ভব।
কিন্তু ক্যালোরি বার্নিং-ই একমাত্র বিষয় নয়। আসল প্রশ্ন হলো – কোনটা বেশি ফ্যাট বার্ন করে?
ফ্যাট বার্নিং:
২০২৫ সালের একটি চাঞ্চল্যকর গবেষণা International Journal of Exercise Science-এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা ভাইরাল “১২-৩-৩০” ওয়ার্কআউট (১২% ঢাল, ৩ মাইল/ঘন্টা গতি, ৩০ মিনিট) এবং দৌড়ানোর তুলনা করেন।
চমকপ্রদ ফলাফল: যদিও দুটি ব্যায়ামই একই পরিমাণ ক্যালোরি পোড়ায়, ঢালে হাঁটা দৌড়ানোর চেয়ে ৭% বেশি ফ্যাট বার্ন করে।
এর কারণ হলো শক্তির উৎস। হাঁটার সময় শরীর শক্তির ৪০% ফ্যাট থেকে নেয়, যেখানে দৌড়ানোর সময় মাত্র ৩৩% ফ্যাট থেকে এবং বাকিটা কার্বোহাইড্রেট থেকে আসে।
মূল বিষয়: যদি আপনার লক্ষ্য হয় শুধু ওজন কমানো নয়, বরং সুনির্দিষ্টভাবে ফ্যাট লস বা চর্বি কমানো, তাহলে ইনক্লাইন বা ঢালে হাঁটা আপনার জন্য বেটার চয়েস।
স্থায়িত্ব: কোন রুটিন দীর্ঘমেয়াদে টিকবে?
ওজন কমানোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। এখানে হাঁটার সবচেয়ে বড় সুবিধা প্রকাশ পায়।
গবেষণায় দেখা গেছে:
- ৯০% মানুষ ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে নিয়মিত হাঁটার রুটিন মেইনটেইন করতে পারে
- মাত্র ২৩% মানুষ দৌড়ানোর রুটিন টিকিয়ে রাখতে পারে
কারণটা সহজ – দৌড়ানো অনেক বেশি তীব্র, ক্লান্তিকর এবং শরীরের উপর চাপ বেশি দেয়। প্রথম কয়েক সপ্তাহ উৎসাহে দৌড়ালেও, এক মাস পর যখন হাঁটু ব্যথা করে, শরীর ক্লান্ত থাকে, তখন মোটিভেশন কমে যায়।
হাঁটা কম তীব্র, সহজে করা যায়, এবং দীর্ঘ সময় ধরে কন্টিনিউ করা সম্ভব। আর ওজন কমানোর সবচেয়ে বড় সিক্রেট হলো consistency – ধারাবাহিকতা।
উদাহরণ: প্রথম দুই সপ্তাহ প্রতিদিন ৩০ মিনিট দৌড়ানোর চেয়ে তিন মাস ধরে প্রতিদিন ৪৫ মিনিট হাঁটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ।
জয়েন্ট এবং ইনজুরির ঝুঁকি:
দৌড়ানো একটি high-impact ব্যায়াম। প্রতিবার পা মাটিতে পড়ার সময় শরীরের ওজনের তিনগুণ পর্যন্ত চাপ হাঁটুতে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে হতে পারে:
দৌড়ানোর সম্ভাব্য সমস্যা:
- হাঁটুর ব্যথা এবং আর্থ্রাইটিস
- শিন স্প্লিন্ট (পায়ের সামনের অংশে ব্যথা)
- গোড়ালি এবং পায়ের পাতার ইনজুরি
- পিঠের নিচের অংশে চাপ
- পেশী এবং টেন্ডনে আঘাত
বিশেষভাবে ঝুঁকিতে যারা:
- যাদের বেশি ওজন (BMI ৩০+)
- আগে থেকে হাঁটুর সমস্যা থাকলে
- বয়স ৪০+ হলে
- আগে কখনো নিয়মিত দৌড়াননি
হাঁটা, বিশেষ করে ইনক্লাইনে হাঁটা, একটি low-impact ব্যায়াম। এটি জয়েন্টের উপর অনেক কম চাপ দেয় এবং ইনজুরির ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কম। যাদের হাঁটু বা জয়েন্টের সমস্যা আছে, তাদের জন্য হাঁটা একমাত্র নিরাপদ অপশন।
মাংসপেশি তৈরি: ইনক্লাইন ওয়াকিং-এর গোপন শক্তি
ঢালে বা ইনক্লাইনে হাঁটার একটি বিশেষ সুবিধা হলো এটি মাংসপেশি তৈরিতেও সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ইনক্লাইনে হাঁটা গ্লুটিয়াল মাংসপেশি (নিতম্বের পেশী) সমতলে হাঁটার চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় করে।
ইনক্লাইনে হাঁটায় যে মাংসপেশিগুলো কাজ করে:
- গ্লুটস (নিতম্বের পেশী) – সবচেয়ে বেশি সক্রিয়
- কোয়াড্রিসেপস (উরুর সামনের পেশী)
- হ্যামস্ট্রিং (উরুর পেছনের পেশী)
- কাভস (পায়ের পিছনের পেশী)
- কোর মাসলস (পেটের পেশী)
শক্তিশালী গ্লুটিয়াল পেশী শুধু শরীরের আকৃতি সুন্দর করে না, বরং গতিশীলতা, স্থিতিশীলতা এবং ভঙ্গি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো নিচের পিঠ এবং হাঁটুকে সমর্থন করে, ইনজুরি এবং ব্যথার ঝুঁকি কমায়।
দৌড়ানো প্রধানত cardiovascular ফিটনেস বাড়ায়, কিন্তু মাংসপেশি তৈরিতে তেমন কার্যকর নয়। ইনক্লাইনে হাঁটা ক্যালোরি বার্ন এবং পেশী শক্তিশালীকরণ দুটোই করে একসাথে।
আপনার জন্য কোনটা সঠিক?
১. শুরু করছেন এবং ওজন অনেক বেশি
হাঁটা দিয়ে শুরু করুন
যদি আপনার BMI ৩০-এর বেশি হয় বা আপনি একদম বিগিনার হন, দৌড়ানো শুরু করা বিপজ্জনক। প্রথম ২-৩ মাস নিয়মিত হাঁটুন। ট্রেডমিলে ০% ইনক্লাইন দিয়ে শুরু করুন, ধীরে ধীরে বাড়ান।
প্ল্যান:
- সপ্তাহে ৫ দিন
- ৩০-৪৫ মিনিট
- ৩-৪ কিমি/ঘন্টা গতি
- প্রতি সপ্তাহে ১-২% ইনক্লাইন বাড়ান
২. সময় কম, দ্রুত ফলাফল চান
সুপারিশ: দৌড়ান, কিন্তু সাবধানে
যদি আপনি ফিট থাকেন, কোনো জয়েন্ট সমস্যা না থাকে, এবং ৩০ মিনিটেই ওয়ার্কআউট শেষ করতে চান, তাহলে দৌড়ানো কার্যকর। তবে সপ্তাহে ৩-৪ দিনের বেশি দৌড়াবেন না।
প্ল্যান:
- সোম-বুধ-শুক্র: ২০-৩০ মিনিট দৌড়ান
- মঙ্গল-বৃহস্পতি: হাঁটুন বা যোগব্যায়াম
- শনি-রবি: একদিন হালকা ব্যায়াম, একদিন রেস্ট
৩. হাঁটুর ব্যথা বা জয়েন্ট সমস্যা আছে
সুপারিশ: শুধুমাত্র হাঁটুন, দৌড়াবেন না
জয়েন্ট সমস্যা থাকলে দৌড়ানো সমস্যা আরও বাড়াবে। ইনক্লাইন হাঁটা আপনার জন্য পারফেক্ট – কম চাপ কিন্তু উচ্চ ফলাফল।
প্ল্যান:
- প্রতিদিন ৪৫-৬০ মিনিট
- ৫-১০% ইনক্লাইন
- মাঝারি গতি (৪-৫ কিমি/ঘন্টা)
৪. লং টার্ম সাস্টেইনেবল ওজন কমাতে চান
সুপারিশ: হাঁটা + মাঝেমধ্যে দৌড়ানো
সবচেয়ে স্মার্ট এপ্রোচ হলো বেস হিসেবে হাঁটা রাখা এবং মাঝেমধ্যে intensity বাড়াতে দৌড়ানো যোগ করা।
প্ল্যান:
- সপ্তাহে ৫ দিন ৪৫ মিনিট ইনক্লাইন হাঁটা
- ১ দিন ২০ মিনিট দৌড়ানো
- ১ দিন রেস্ট বা যোগব্যায়াম
ইনক্লাইন হাঁটার কৌশল:
১২-৩-৩০ ফর্মুলা
১২% ইনক্লাইন, ৩ মাইল/ঘন্টা (৪.৮ কিমি/ঘন্টা) গতি, ৩০ মিনিট। এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে কারণ এটি সত্যিই কাজ করে। তবে বিগিনারদের জন্য এটি কঠিন হতে পারে।
বিগিনার ভার্সন:
- প্রথম সপ্তাহ: ৫% ইনক্লাইন, ২০ মিনিট
- দ্বিতীয় সপ্তাহ: ৭% ইনক্লাইন, ২৫ মিনিট
- তৃতীয় সপ্তাহ: ১০% ইনক্লাইন, ৩০ মিনিট
- চতুর্থ সপ্তাহ: ১২% ইনক্লাইন, ৩০ মিনিট
ইন্টারভাল ইনক্লাইন
৫ মিনিট ৫% ইনক্লাইন, ৫ মিনিট ১০% ইনক্লাইন, ৫ মিনিট ১৫% ইনক্লাইন – এভাবে রোটেশন করুন। এটি একঘেয়েমি দূর করে এবং বেশি ক্যালোরি বার্ন করে।
হাতে ওজন নিয়ে হাঁটা
০.৫-১ কেজি ডাম্বেল হাতে নিয়ে হাঁটলে ক্যালোরি বার্ন ১৫-২০% বাড়ে। তবে শুরুতে এটা না করাই ভালো।
দৌড়ানোর কৌশল:
ইন্টারভাল ট্রেনিং
১ মিনিট দ্রুত দৌড়, ২ মিনিট ধীরে জগিং – এভাবে ২০ মিনিট করুন। এটি ক্যালোরি বার্ন ৩০% পর্যন্ত বাড়াতে পারে এবং একঘেয়েমি দূর করে।
সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন
- মাথা সোজা রাখুন, সামনে তাকান
- কাঁধ রিল্যাক্সড এবং পেছনে
- কোর টাইট রাখুন
- পা মাটিতে মাঝখান দিয়ে ল্যান্ড করান (হিল বা পায়ের আঙুল দিয়ে নয়)
- হাত ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁকানো
একটা কথা মনে রাখবেন – “Abs are made in the kitchen, not in the gym.” শুধু ট্রেডমিলে হাঁটলে বা দৌড়ালেই ওজন কমবে না। ডায়েট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
যদি আপনি প্রতিদিন ৪৫ মিনিট হাঁটেন এবং ৩০০ ক্যালোরি পোড়ান, কিন্তু তারপর বাসায় গিয়ে ২টা সিঙ্গারা (৪০০ ক্যালোরি) খান, তাহলে ওজন কমবে না, বরং বাড়বে!
ক্যালোরি ডেফিসিট তৈরি করুন:
ওজন কমাতে হলে আপনাকে যা খাচ্ছেন তার চেয়ে বেশি ক্যালোরি পোড়াতে হবে। দিনে ৫০০ ক্যালোরি ডেফিসিট তৈরি করলে সপ্তাহে প্রায় ০.৫ কেজি ওজন কমে – যা স্বাস্থ্যকর এবং টেকসই।
বাংলাদেশি খাবার নিয়ন্ত্রণে:
যা কমাতে হবে:
- ভাত (দিনে ২-৩ কাপ থেকে ১-২ কাপে নামিয়ে আনুন)
- তেলে ভাজা খাবার (সিঙ্গারা, সমুচা, পিয়াজু)
- বিরিয়ানি এবং তৈলাক্ত খাবার
- চিনিযুক্ত খাবার এবং কোমল পানীয়
- প্রসেসড ফুড এবং ফাস্ট ফুড
যা বাড়াতে হবে:
- প্রোটিন: ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, ডাল
- সবজি: প্রতি বেলায় থালার অর্ধেক সবজি রাখুন
- পানি: প্রতিদিন ২-৩ লিটার
- ফল: দিনে ২-৩ টি মৌসুমি ফল
- স্বাস্থ্যকর ফ্যাট: বাদাম, অলিভ অয়েল (পরিমাণমতো)
রাতের খাবার হালকা রাখুন:
রাত ৮টার পর ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন। রাতে ডাল, সবজি এবং অল্প ভাত খান। প্রোটিন বেশি রাখুন।
কনসিস্টেন্সি: সবচেয়ে বড় সাফল্যের চাবিকাঠি
আপনি হাঁটেন বা দৌড়ান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিয়মিত করা। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে সপ্তাহে একদিন ২ ঘন্টা তীব্র ব্যায়ামের চেয়ে, সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট মাঝারি intensity-র ব্যায়াম অনেক বেশি কার্যকর।
কারণ:
- নিয়মিততা মেটাবলিজম বাড়ায়
- ভালো অভ্যাস তৈরি করে
- দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা সহজ
- শরীর এবং মন দুটোই খাপ খাইয়ে নেয়
দ্রুত ওজন কমাতে চাইলে + ফিট থাকলে:
দৌড়ান – সপ্তাহে ৩-৪ দিন, ২০-৩০ মিনিট
ফ্যাট লস + মাংসপেশি তৈরি করতে চাইলে:
ইনক্লাইনে হাঁটুন – সপ্তাহে ৫-৬ দিন, ৩০-৪৫ মিনিট
দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ওজন কমাতে চাইলে:
হাঁটা + মাঝেমধ্যে দৌড়ানো – বেস হিসেবে হাঁটা, সপ্তাহে ১-২ দিন দৌড়ানো
জয়েন্ট সমস্যা থাকলে বা বয়স ৪০+:
শুধু হাঁটুন, দৌড়াবেন না – ইনক্লাইনে হাঁটা আপনার জন্য পারফেক্ট
একদম বিগিনার:
হাঁটা দিয়ে শুরু করুন – ২-৩ মাস পর দৌড়ানো শুরু করতে পারেন
ওজন কমানোর যাত্রায় একটাই সত্য—
সেরা ব্যায়াম হলো যেটা আপনি নিয়মিত করতে পারবেন।

