“ভাই, আগের মতো আর নিজেকে লাগে না। আগেও তো চাপ ছিল, কিন্তু এখন যেন ভিতরটা বদলে গেছে…”
ঢাকার এক কর্পোরেট চাকরিজীবী রিয়াজ এই কথাটা বলছিল তার বন্ধুকে। গত কয়েক মাস ধরে দেরি করে অফিস ছাড়া, বাড়ি ফিরেই একা একা থাকাটা, পরিবারের চাপ, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে তার ভেতরের সেই চেনা মানুষটা যেন বদলে যাচ্ছে।
এবং আজ বিজ্ঞান বলছে, রিয়াজের অনুভূতি একদম ভুল না।
কেননা মানসিক চাপ শুধু মন নয়, আমাদের শরীরের সবচেয়ে গোপনীয় জায়গা—জিন—এও বদল আনে।
এপিজেনেটিক্স: যখন অভিজ্ঞতা ছাপ ফেলে জিনে
আমরা জানি, আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে আছে জিন (DNA), যা আমাদের চোখের রঙ, উচ্চতা, এমনকি রোগপ্রবণতা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু একে কেবল একটি নির্ধারিত স্ক্রিপ্ট ভাবলে ভুল হবে।
জিনের ওপর একপ্রকার “অন-অফ সুইচ” আছে। আর সেই সুইচ নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, এমনকি মানসিক চাপ।
এই প্রক্রিয়াকে বলে এপিজেনেটিক্স।
চাপ বেশি থাকলে, আমাদের কিছু জিন “অ্যাকটিভ” বা “সাইলেন্ট” হয়ে যেতে পারে। যেমন, এমন কিছু জিন আছে যা মানসিক স্থিতি বা রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে—চাপের ফলে সেগুলোর কাজ কমে যায়।
কোর্টিসল: শরীরের স্ট্রেস হরমোন
চাপের সময় আমাদের শরীর কোর্টিসল নামে একটি হরমোন তৈরি করে। স্বল্পমেয়াদে এটি সহায়ক—বাঁচার জন্য দৌড়ানো, বিপদ থেকে সরে যাওয়া, এসবের জন্য দরকার।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস কোর্টিসলের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। এই কোর্টিসল তখন:
- মস্তিষ্কে নিউরন ক্ষতি করে
- ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে
- ঘুম, ক্ষুধা ও চিন্তার ভারসাম্য নষ্ট করে
এবং সবচেয়ে বড় কথা, এটি জিনের ওপর এপিজেনেটিক ছাপ রেখে দেয়।
শিশুদের ওপর প্রভাব: চাপ শুধু নিজের না
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মায়েরা গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন, তাদের সন্তানের জিনেও সেই চাপের ছাপ পাওয়া গেছে।
এমনকি ছোট বয়সে মা-বাবার কলহ, নিরাপত্তাহীনতা, বা অবহেলার প্রভাবও শিশুদের ভবিষ্যতের মানসিক স্বাস্থ্যে ছাপ ফেলে—জিন স্তরে।
সোজা ভাষায়, চাপ শুধু আপনার আজকের সমস্যা না, এটা আপনার পরবর্তী প্রজন্মেরও সমস্যা হতে পারে।
একজন ব্যাচেলরের অভিজ্ঞতা: রিয়াজের জার্নি
রিয়াজ, ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ, কর্পোরেট চাকরিতে ঢুকেছিলেন বড় স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু প্রতিদিনের অফিস টার্গেট, বসের চাপে অনিদ্রা, বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ—সবকিছু মিলে তিনি অল্পতেই রেগে যেতেন, কথায় কথায় কাঁদতেন।
একসময় মনে হচ্ছিল তিনি “আগের মতো না”। এক চিকিৎসক পরামর্শ দেন, মেডিটেশন শুরু করতে, ঘুম ঠিক করতে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে।
রিয়াজ সেই পরামর্শ মেনে চলেন। ৩ মাস পর তিনি বলেন, “আমি এখনো একই কাজ করি, কিন্তু চাপটা আর গায়ে লাগে না।”
তার ব্রেন স্ক্যানেও দেখা যায় কোর্টিসলের মাত্রা কমেছে।
মানসিক চাপ কমাতে ৫টি বৈজ্ঞানিক কৌশল
১. মেডিটেশন বা ধ্যান
প্রতিদিন ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দিন। এটি Amygdala (ভয়ের কেন্দ্র) কে শান্ত করে।
২. শরীরচর্চা (Exercise)
প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা জগিং—এটি কোর্টিসল কমায়, এন্ডরফিন বাড়ায়।
৩. প্রকৃতির সংস্পর্শ
গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ২০ মিনিট গাছের পাশে থাকলে স্ট্রেস হরমোন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।
৪. রুটিন তৈরি করুন
নিয়মিত ঘুম, খাওয়া, কাজের সময়—এতে মস্তিষ্ক নিরাপদ অনুভব করে।
৫. নিজের সঙ্গে কথা বলুন
নিজেকে বলুন: “তুই পারবি”, “সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।” পজেটিভ সেলফ-টকও জিন অ্যাক্টিভেশনে ভূমিকা রাখে।
চাপকে ছোট ভাববেন না
মানসিক চাপ যে শুধু দুঃখ বা ক্লান্তির নাম নয়, তা এখন বিজ্ঞানও বলছে।
এটা আমাদের ব্রেনের কাঠামো বদলায়, জিনে ছাপ ফেলে, এমনকি ভবিষ্যতের প্রজন্মেও প্রভাব ফেলে।
তাই আপনি যদি এখন চাপের মধ্যে থাকেন, জেনে রাখুন—এই পরিবর্তন শুধু বাহ্যিক না, এটা আপনার ভিতরেও চলতে থাকা বিপ্লব।
কিন্তু আপনি যদি আজ থেকেই কিছু সহজ, ছোট অভ্যাস গড়ে তুলেন, তাহলে আপনি শুধু চাপ কমাবেন না—আপনার শরীরের সবচেয়ে সূক্ষ্ম জায়গায়, জিনেও ইতিবাচক ছাপ ফেলবেন।