রায়হান, ঢাকার এক এজেন্সিতে চাকরি করেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ক্লায়েন্ট ব্রিফ, মিটিং, প্রেসার আর স্ক্রিন—সব মিলিয়ে মাথা যেন গরম হয়ে যায়। একদিন লাঞ্চের পরে অফিসের রেস্টরুমে ২০ মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলেন। জেগে উঠে দেখলেন—মনটা হালকা, মাথাটা পরিষ্কার। কাজেও গতি বেড়েছে।
তিনি হয়তো জানতেন না, কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার মস্তিষ্ক ‘রিচার্জ’ নিচ্ছিল। শুধু মনই না, তার ব্রেনও হয়তো বয়সের ঘড়িটাকে একটু পিছিয়ে দিলো।
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত: ন্যাপ মানেই ব্রেন ইয়াং!
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় (University College London ও Uruguay-এর University of the Republic) দেখা গেছে—
যারা দিনে মাঝে মাঝে ২০–৩০ মিনিটের একটি ন্যাপ (স্বল্প সময়ের বিশ্রামঘুম) নেন, তাদের মস্তিষ্কের গঠন বেশি সুস্থ ও পরিপাটি থাকে।
বয়স বাড়লেও তাদের ব্রেনের আকার ছোট হয় না, বরং প্রায় ৬ বছর ‘বয়স কম’ দেখায় স্ক্যান রিপোর্টে।
গবেষকরা বলছেন, এটা অলসতা নয়—এটা আমাদের ব্রেনের ‘সার্ভিসিং’। এক কাপ চায়ের মতো, কিন্তু আরও গভীর।
প্রাচীন গ্রীস থেকে আধুনিক অফিস ডেস্ক—ন্যাপের ইতিহাস
ন্যাপ বা ঝটিকা ঘুম কোনো নতুন ট্রেন্ড না।
প্রাচীন গ্রীসে দার্শনিকেরা দুপুরে ন্যাপ নিতেন মস্তিষ্ককে শান্ত রাখতে।
জাপানে একে বলা হয় “ইনেমুরি”—অর্থাৎ ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বেও দায়িত্ববান থাকা!
অনেক অফিসেই ন্যাপ নেওয়া কর্মীদের আরও প্রোডাকটিভ মনে করা হয়।
আমেরিকার Google, Nike, NASA-এর মতো কোম্পানিগুলো ন্যাপ পড বসিয়েছে—যেখানে কর্মীরা চাইলে দুপুরে ২০ মিনিট ঘুমাতে পারেন।
তাহলে আমাদের এখানেই বা কেন নয়?
কেন এত উপকার? ন্যাপ কীভাবে কাজ করে?
১. স্মৃতিশক্তি বাড়ায়
- ন্যাপ নেওয়ার সময় ব্রেনের হিপোক্যাম্পাসে তথ্য গুছিয়ে রাখার কাজ হয়।
- ফলে পড়া মনে থাকে বেশি, শেখা সহজ হয়।
২. মুড ভালো করে
- মাত্র ২০ মিনিটের ন্যাপে কর্টিসল কমে যায় (স্ট্রেস হরমোন)।
- মানসিক চাপ কমে, মনটা ফুরফুরে হয়।
- মনোযোগ বাড়ায়
যাদের প্রতিদিন দীর্ঘ সময় মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হয়, তাদের ব্রেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
- এক কাপ কফির চেয়েও বেশি কার্যকর হতে পারে একটি ছোট্ট ন্যাপ।
৪. হরমোন ব্যালেন্স রাখে
- ব্রেনের বিশ্রাম মানে সারা শরীরের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা।
- ঘুমের অভাবে বেড়ে যাওয়া ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমে যায়।
৫. মস্তিষ্কের বয়স কমায়
- হ্যাঁ, এই গবেষণাটির মূল কথা এটাই।
- নিয়মিত ন্যাপ মানে নিউরনের স্বাস্থ্য ভালো থাকা, মানে বয়সের তুলনায় ‘তরুণ’ থাকা।
কেমন ন্যাপ সবচেয়ে কার্যকর?
সময়:
- আদর্শ ন্যাপ ২০–৩০ মিনিটের।
- এর বেশি ঘুমালে আপনি গভীর ঘুমে চলে যেতে পারেন, যার ফলে ঘুম থেকে উঠে মাথা ভার লাগতে পারে।
সময়কাল:
- দুপুর ১টা থেকে ৩টার মধ্যে ন্যাপ নেওয়াই সবচেয়ে ভালো।
- এর আগে/পরে নিলে রাতের ঘুম ব্যাহত হতে পারে।
পরিবেশ:
- শান্ত, ঠান্ডা, অন্ধকার বা হালকা আলোযুক্ত পরিবেশ বেছে নিন।
- চোখে মাস্ক বা কানে হেডফোন দিয়ে হালকা মিউজিক শুনতে পারেন।
বাংলাদেশে বাস্তব অভিজ্ঞতা: “একটা ছোট ঘুমেই বদলে গেলো দিনটা”
নারগিস বেগম, চট্টগ্রামের এক স্কুলশিক্ষিকা।
বলেন, “আমি দুপুরে একটু ন্যাপ নিই, তা নিয়েই অনেক বলে—‘ঘুমকাতুরে’! কিন্তু ক্লাসে আমি যেভাবে এনার্জি নিয়ে পড়াই, অনেকে দেখে অবাক হয়।”
তার নিজের কথায়, “এই একটা অভ্যাস আমাকে দিনের দ্বিতীয় ভাগে ফ্রেশ রাখে। ভুল কম হয়, মাথা হালকা থাকে।”
আপনি যদি স্টুডেন্ট হন—
- পরীক্ষার আগে ছোট্ট ন্যাপ নিলে রিভিশন ভালো হয়।
- ঘুমের সময় ব্রেন নিজেই তথ্য গুছিয়ে রাখে।
আপনি যদি চাকরি করেন—
- দুপুরে ১৫ মিনিট চোখ বন্ধ করেই দেখুন, বিকেলে আপনার কাজে এনার্জি ফিরবে।
- মুড ভালো থাকবে, মিটিংয়ে মনযোগ বাড়বে।
ঘুম মানেই অলসতা নয়
আমাদের সমাজে একটা ভুল ধারণা আছে—“দিনে ঘুম মানে সময় নষ্ট।”
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় এটা আজ প্রমাণিত—
“একটি ছোট্ট বিশ্রাম আপনাকে দীর্ঘস্থায়ী এনার্জি দিতে পারে।”
আপনার মস্তিষ্ক, আপনার শক্তি—এটা রিচার্জ নিতে চায়, সেটা আপনি দিবেন কিনা, এখন সিদ্ধান্ত আপনার।
আজ থেকেই ন্যাপ নিতে একটু সময় বের করুন। আর দেখুন, কেমন করে আপনার মস্তিষ্ক আবার নতুন হয়ে উঠছে—যুবকের মতো।