back to top
মঙ্গলবার, জুলাই ২৯, ২০২৫
HomeInspirationAdviceসঠিক প্যারেন্টিং: ভালোবাসা, সময় ও বোঝাপড়ার সবচেয়ে বড় শিক্ষা

সঠিক প্যারেন্টিং: ভালোবাসা, সময় ও বোঝাপড়ার সবচেয়ে বড় শিক্ষা

একবার ভাবুন, শৈশবের সেই মধুর স্মৃতিগুলো কিসে গড়ে উঠেছিল? বাবা-মায়ের হাত ধরে হাঁটা, একসাথে বসে গল্প শোনা, স্কুল শেষে মায়ের হাসিমুখের অভ্যর্থনা—এগুলোই ছিল নিরাপত্তা ও ভালোবাসার চাবিকাঠি। আজকের দ্রুতগতির জীবনে অনেক বাবা-মা সন্তানদের হাতে ফোন বা ট্যাবলেট দিয়ে ব্যস্ততা সামলান। কিন্তু এটাই কি সত্যিকারের সমাধান?

একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, “শিশুরা আপনাকে মনে রাখে না কারণ আপনি কত টাকা রোজগার করেছেন, তারা মনে রাখে আপনি কতটা সময় ও মনোযোগ দিয়েছেন।”

সঠিক প্যারেন্টিং আসলে কী?

প্যারেন্টিং মানে শুধু সন্তানকে খাওয়ানো বা স্কুলে পাঠানো নয়। এটা হলো এমন একটি যাত্রা যেখানে আপনি তার ভেতরের ব্যক্তিত্ব গড়ে দেন। সঠিক প্যারেন্টিংয়ের মূল তিনটি স্তম্ভ—ভালোবাসা, সময় ও বোঝাপড়া।

১. ভালোবাসার ভাষা:

শিশুদের জন্য ভালোবাসা মানে শুধু চকলেট বা উপহার নয়। মায়ের একটি আলিঙ্গন, বাবার হাত ধরা—এটাই তাদের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট সন্তানকে জড়িয়ে ধরা বা তার কথা শোনা তার মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

২. সময় দেওয়া:

ফোনে স্ক্রল করার সময় যদি আমরা অর্ধেকটা সন্তানকে দিই, তাহলে তার অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। প্রতিদিন কিছু সময় শুধু তার সঙ্গে খেলায় বা গল্পে ব্যয় করা, তাকে ছোট ছোট কাজ শেখানো—এগুলোই তার মস্তিষ্কে সৃজনশীলতা জাগায়।

৩. বোঝাপড়ার ক্ষমতা:

শিশুরা মাঝে মাঝে রাগ করে, কান্না করে। তখন অনেকেই বলে, “চুপ করো, এটা কোনো ব্যাপার না।” কিন্তু একজন বুদ্ধিমান প্যারেন্ট বলেন—“আমি বুঝতে পারছি তুমি কষ্ট পাচ্ছো, চলো কথা বলি।” এই সামান্য বোঝাপড়াই তার আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে।

শিশুর হাতে ফোন দেওয়ার ফাঁদ

আজকাল ২-৩ বছরের বাচ্চারা ট্যাবলেট ছাড়া খেতে চায় না। গবেষণা বলছে, বেশি স্ক্রিন টাইম শিশুর মনোযোগ কমায়, আচরণে অস্থিরতা বাড়ায় এবং সৃজনশীলতা কমিয়ে দেয়। ফোন কোনো চুপ করানোর যন্ত্র নয়, বরং এটি সন্তানের সাথে সম্পর্ক কমিয়ে আনে।

বাংলাদেশে শহুরে জীবনে অনেকেই মনে করেন—“ফোন না দিলে ও খায় না।” কিন্তু বিকল্প আছে। যেমন—খাবারের সময় তাকে গল্প শোনানো, ছোট ছোট খেলা তৈরি করা।

পজিটিভ প্যারেন্টিং: ছোট পরিবর্তন, বড় প্রভাব

১. নিয়মিত কথা বলুন:

প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট সন্তানের সাথে তার দিন নিয়ে কথা বলুন। এতে বাবা-মায়ের সাথে তার সম্পর্ক গভীর হয়।

২. একসাথে কাজ করুন:

খাবার তৈরি বা ছোট গৃহকর্মে তাকে অন্তর্ভুক্ত করুন। এতে তার দায়িত্ববোধ বাড়ে।

৩. খেলাধুলার সময় দিন:

ফিজিক্যাল গেম যেমন দড়ি লাফ, ফুটবল, বা ঘরের ছোট গেম—এগুলো ফোনের চেয়ে বেশি আনন্দ ও শেখার সুযোগ দেয়।

৪. ভুল হলে বকবেন না, বোঝাবেন:

কিছু ভুল করলেই রাগ করার বদলে তাকে বোঝান কেন সেটা ঠিক নয়। এর মাধ্যমে সে শেখে কিভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়।

৫. পজেটিভ প্রশংসা করুন:

ছোট কাজের জন্যও তাকে প্রশংসা করুন। যেমন—“তুমি আজ খেলনা গুছিয়ে রেখেছ, দারুণ কাজ!” এই প্রশংসা তার আত্মমর্যাদা বাড়ায়।

বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে বাস্তব উদাহরণ

আসফিয়া তার ৭ বছরের মেয়েকে  প্রতিদিন আধা ঘণ্টা গল্প শোনান। আগে সে সারাদিন মোবাইলে গেম খেলত। কিন্তু এখন সে নিজের খাতায় গল্প লিখতে শুরু করেছে। আসফিয়া আপার ভাষায়—

“শুধু মোবাইল সরিয়ে একটু সময় দেওয়ার মধ্যেই আমি আমার সন্তানের হাসি ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।”

সঠিক প্যারেন্টিং কেন জরুরি?

একজন শিশু শুধু স্কুল বা বই থেকে শিখে না, শিখে বাবা-মায়ের আচরণ থেকে। আপনি যদি ফোনে ব্যস্ত থাকেন, তারাও ফোনকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাববে। আর যদি আপনি তাকে সময় দেন, তার মনের প্রশ্ন শুনেন, তবে সে বুঝবে—“আমি মূল্যবান।”

সন্তানকে ভালোবাসার সাথে শাসন করতে হয়, কিন্তু শাসনের আগে তাকে বুঝতে হয়।

ভালোবাসা ও সময়ই আসল উত্তর

প্যারেন্টিং কখনোই পারফেক্ট নয়। কিন্তু সঠিক প্যারেন্টিং মানে আপনার সন্তানকে বোঝানো—“আমি তোমার পাশে আছি।”

আজকের দিনে ফোন বা ট্যাবলেট দিয়ে চুপ করানোর চেয়ে, একটু গল্প, একটু খেলা, একটু সময় দিতে পারলেই সন্তানের হৃদয় জয় করা সম্ভব।

যদি আপনি ভাবেন, “আমি ব্যস্ত, সময় পাই না,” তাহলে মনে রাখবেন—এই মুহূর্তগুলো একদিন ফিরবে না। আপনার দেওয়া সময়ই সন্তানের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি হয়ে থাকবে।

আজই একটা প্রতিজ্ঞা নিন:

– প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ফোন ছাড়া সময় দেব।

– সন্তানের সাথে খোলামেলা কথা বলব।

– তার হাসি ও চোখের আনন্দটাই আমার প্রকৃত অর্জন হবে।

সন্তানকে বড় করতে হলে কেবল শাসন নয়, ভালোবাসা, বোঝাপড়া এবং উদাহরণ হয়ে ওঠাটাই সেরা শিক্ষা। কারণ শেষমেশ সে যেটা মনে রাখবে, সেটা হলো—“আমার বাবা-মা আমাকে সময় দিয়েছিল, বুঝেছিল, আর ভালোবেসেছিল।”

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular