৪৩তম জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের শেষ রাউন্ড। দাবার বোর্ডের সামনে বসে আছেন নোশিন আনজুম। তার সামনে খুশবু। দুজনই বাংলাদেশ নেভির খেলোয়াড়, দুজনই সতীর্থ। নোশিনের মাত্র একটি ড্র দরকার—এবং তৃতীয়বারের মতো জাতীয় শিরোপা তার হাতে।
মাত্র ছয় চালেই খেলা শেষ। দুজন করমর্দন করলেন, ড্র মেনে নিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে একজন চ্যাম্পিয়নের বড় হৃদয়—নোশিন নিজে থেকেই ড্র অফার করেছিলেন যাতে খুশবু অলিম্পিয়াড টিমে জায়গা পায়।
“আমি চেয়েছিলাম খুশবু অলিম্পিয়াড টিমে থাকুক,” ম্যাচ শেষে বলেন নোশিন। “এটা ছিল আমাদের পারস্পরিক সিদ্ধান্ত, বোর্ডে আলোচনার ভিত্তিতে।”
এই একটি বাক্যই বলে দেয় নোশিন আনজুম শুধু একজন দাবা খেলোয়াড় নন—তিনি একজন সত্যিকারের ক্রীড়া নেতা, যিনি জানেন কীভাবে জয়ের সাথে মানবিকতার ভারসাম্য রাখতে হয়।
হারের তলানি থেকে চ্যাম্পিয়নশিপের শীর্ষে
নোশিন আনজুম ১১ রাউন্ড থেকে ৮.৫ পয়েন্ট নিয়ে টানা তৃতীয়বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। কিন্তু এই জয়ের পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। বরং বলা যায়, এবারের চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল তার ক্যারিয়ারের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং।
প্রথম ছয় রাউন্ডে কুমিল্লার নুসরাত জাহান আলোর কাছে হেরে যান নোশিন। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল হয়তো এবার মুকুট হাতছাড়া। কিন্তু একজন চ্যাম্পিয়ন এবং একজন সাধারণ খেলোয়াড়ের মধ্যে পার্থক্য এখানেই—চ্যাম্পিয়নরা হার থেকে শেখে, হাল ছাড়ে না।
মায়ের অনুপ্রেরণা যখন হয়ে ওঠে জেতার চাবিকাঠি
“আলোর কাছে হারার পর আমি খুবই মনমরা ছিলাম,” স্বীকার করেন নোশিন। “কিন্তু আমার মা আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, হার তো হয়েই গেছে, এখন বাকি ম্যাচগুলোতে মনোযোগ দাও। সেই কথাই আমাকে শক্তি দিয়েছিল।”
সাতটি জয়, তিনটি ড্র এবং মাত্র একটি পরাজয়। নোশিন শুধু টপে ফিরে আসেননি, বরং শেষ পর্যন্ত সেখানে টিকে থেকে প্রমাণ করেছেন—এক রাতের ঝড় সকালের সূর্যকে আটকাতে পারে না।
এটাই চ্যাম্পিয়ন মানসিকতা। পরাজয় স্বীকার করা, কিন্তু পরাজিত না হওয়া।
একজন ছাত্রী যিনি দেখাচ্ছেন সবকিছু সম্ভব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী নোশিন আনজুম। সকালে ক্লাস, দুপুরে প্রশিক্ষণ, সন্ধ্যায় নেভির দায়িত্ব, রাতে পড়াশোনা—এই ভারসাম্য রক্ষা করা সাধারণ কোনো কাজ নয়। কিন্তু নোশিন প্রমাণ করছেন, সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা এবং লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ় মনোভাব থাকলে সবকিছুই সম্ভব।
২০১৬ সাল থেকে জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে খেলছেন তিনি। তখন ছিলেন একজন উদীয়মান প্রতিভা। আর এখন? বাংলাদেশের নারী দাবার প্রতিনিধি। ২০২২ সালে প্রথমবার জাতীয় শিরোপা জেতেন, এবং এখন টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন—এটা শুধু ভাগ্য নয়, এটা নিরলস পরিশ্রম ও নিবেদনের ফল।
নোশিন বলেছেন, এখনকার প্রতিযোগিতা অনেক কঠিন। তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, অনলাইনে শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের সাথে অনুশীলন করছেন। এই পরিবেশে চ্যাম্পিয়ন থাকা প্রতিবছর কঠিন হচ্ছে—এবং সেখানেই নোশিনের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে।
ফিডে মাস্টার থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার: একটা দীর্ঘ কিন্তু স্বপ্নময় পথ
নোশিন আনজুম বর্তমানে বাংলাদেশ নেভির একজন ফিডে মাস্টার। কিন্তু তার স্বপ্ন অনেক বড়—শুধু উইমেন গ্র্যান্ডমাস্টার নয়, তিনি হতে চান ফুল গ্র্যান্ডমাস্টার।
গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব দাবায় সর্বোচ্চ সম্মান, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। বাংলাদেশে এখনো কোনো মহিলা খেলোয়াড় এই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি। নোশিন চান সেই ইতিহাস রচনা করতে।
উইমেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হতে হলে নোশিনকে তিনটি আন্তর্জাতিক মাস্টার নর্ম এবং ২২০০ রেটিং অর্জন করতে হবে। তার বর্তমান রেটিং ১৯৯০ এবং ইতিমধ্যে দুটি নর্ম অর্জন করেছেন। মানে আরও একটি নর্ম এবং ২১০ রেটিং পয়েন্ট—শুনতে সহজ মনে হলেও দাবার জগতে এটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
আর গ্র্যান্ডমাস্টার? সেখানে দরকার আরও উচ্চ রেটিং (২৫০০+), তিনটি গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম এবং বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক জয়। এবং এসব প্রায় সবসময় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অর্জিত হয়।
সবচেয়ে বড় বাধা: অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা
“আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ সীমিত,” বলেন নোশিন। “আর্থিক কারণে বিদেশে খেলতে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আর আন্তর্জাতিক এক্সপোজার ছাড়া গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া প্রায় অসম্ভব।”
ভাবুন তো, একজন তিনবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, যার প্রতিভা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আকাশছোঁয়া, শুধুমাত্র অর্থের অভাবে তার পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারছেন না। এটা শুধু নোশিনের সমস্যা নয়—এটা আমাদের পুরো ক্রীড়া ব্যবস্থার সমস্যা।
একটি টিম, একটি পরিবার: নোশিনের নেতৃত্ব
নোশিনের সবচেয়ে বড় শক্তি শুধু তার দাবা দক্ষতা নয়—তার টিম স্পিরিট এবং নেতৃত্ব। শেষ রাউন্ডে খুশবুকে ড্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত এটাই প্রমাণ করে। একজন সাধারণ খেলোয়াড় হয়তো খেলে জিতে নিজের আধিপত্য প্রমাণ করতেন। কিন্তু নোশিন বুঝেছিলেন, সতীর্থের ভবিষ্যৎ আরও গুরুত্বপূর্ণ।
এই মানসিকতাই একটি টিমকে শক্তিশালী করে। আগামী অলিম্পিয়াডে যখন নোশিন এবং খুশবু একসাথে বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন, তখন এই বন্ধন, এই বিশ্বাস কাজে আসবে।
আগামী অলিম্পিয়াড টিম: নতুন প্রজন্মের উত্থান
উইমেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ওয়াদিফা আহমেদ, উইমেন ক্যান্ডিডেট মাস্টার ওয়ালিজাহ আহমেদ এবং উইমেন ক্যান্ডিডেট মাস্টার নুসরাত জাহান আলো—প্রত্যেকে সাত পয়েন্ট নিয়ে শেষ করেছেন। রানার-আপ থেকে চতুর্থ স্থান নির্ধারণের জন্য তারা প্লে-অফ খেলবেন।
এই তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা উজবেকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য আগামী অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। নোশিনের সাথে তারা গঠন করবেন একটি শক্তিশালী, প্রতিশ্রুতিশীল টিম।
ওয়াদিফা, ওয়ালিজাহ, নুসরাত, খুশবু—এই নামগুলো মনে রাখুন। এরাই বাংলাদেশের নারী দাবার ভবিষ্যৎ। এবং নোশিন আনজুম তাদের অনুপ্রেরণা, তাদের রোল মডেল।
একটি যুগের সমাপ্তি: রানী হামিদের অনুপস্থিতি
এবারের চ্যাম্পিয়নশিপে উইমেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার রানী হামিদ ১১তম স্থানে শেষ করেছেন এবং আগামী বছর উজবেকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করবেন না।
বাংলাদেশের প্রথম উইমেন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার রানী হামিদ ১৯৮৫ সালে এই উপাধি অর্জন করেন এবং ২০ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ৮১ বছর বয়সেও তিনি দাবার বোর্ডে লড়ছেন—এটা নিজেই একটা অনুপ্রেরণা। কিন্তু এবার অলিম্পিয়াড টিম থেকে বাদ পড়া নিঃসন্দেহে একটি যুগের সমাপ্তির ইঙ্গিত।
রানী হামিদ শুধু একজন খেলোয়াড় নন—তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি কিংবদন্তি। ৩৪ বছর বয়সে দাবা শুরু করেছিলেন, এবং পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশের নারী দাবাকে একক প্রচেষ্টায় বিশ্ব মানচিত্রে তুলে এনেছেন।
এটাই সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার—প্রজন্মের পর প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে, স্বপ্ন দেখছে আরও বড়, আরও উঁচুতে পৌঁছাচ্ছে।
নোশিনের এই যাত্রা শুধু একটা দাবা খেলোয়াড়ের গল্প নয়—এটা একজন স্বপ্নদ্রষ্টার গল্প, একজন লড়াকু মেয়ের গল্প। তার গল্প থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
১. হার মানেই শেষ নয়
প্রথম ছয় রাউন্ডে হেরে গিয়েও নোশিন ফিরে এসেছেন। প্রমাণ করেছেন, এক রাতের ব্যর্থতা পুরো গল্প বদলে দিতে পারে না—যদি আপনি হাল না ছাড়েন।
২. টিম আগে, ব্যক্তি পরে
নিজের জয় নিশ্চিত করার পরও সতীর্থের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছেন নোশিন। এটাই সত্যিকারের নেতৃত্ব—যেখানে আপনি শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য ভাবেন।
৩. ভারসাম্যই সাফল্যের চাবিকাঠি
পড়াশোনা, খেলা, নেভির দায়িত্ব—সবকিছু একসাথে সামলিয়ে নোশিন প্রমাণ করেছেন, সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা এবং নিবেদন থাকলে সবকিছুই সম্ভব।
৪. বড় স্বপ্ন দেখার সাহস
উইমেন গ্র্যান্ডমাস্টার নয়, ফুল গ্র্যান্ডমাস্টার—এই সাহসই তরুণদের অনুপ্রাণিত করবে সীমানা ভাঙতে, আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে।
যা প্রয়োজন: সমর্থন, সুযোগ এবং বিনিয়োগ
নোশিন আনজুম এবং তার মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বেশি দরকার তিনটি জিনিস:
আর্থিক সহায়তা
আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল। গ্র্যান্ডমাস্টার হতে হলে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অপরিহার্য—এবং সেটার জন্য প্রয়োজন অর্থ, কর্পোরেট স্পন্সরশিপ।
প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ নেভিকে এগিয়ে আসতে হবে। নিয়মিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে পাঠাতে হবে, বিদেশি কোচের ব্যবস্থা করতে হবে।
মিডিয়া কভারেজ এবং জনসচেতনতা
ফুটবল, ক্রিকেটের মতো দাবাতেও মনোযোগ দরকার। মিডিয়া যত বেশি কভারেজ দেবে, তত বেশি স্পন্সর আসবে, তত বেশি তরুণ-তরুণী অনুপ্রাণিত হবে।
দাবা শুধু একটা খেলা নয়—এটা মানসিক দক্ষতা, কৌশলগত চিন্তাভাবনা এবং ধৈর্যের সমন্বয়। এবং বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে দাবা একটা অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম।
চ্যাম্পিয়নের পরবর্তী গন্তব্য: উজবেকিস্তান অলিম্পিয়াড
এখন নোশিনের সামনে রয়েছে উজবেকিস্তানে অলিম্পিয়াড। এটি তার জন্য একটি বিশাল সুযোগ—শুধু দেশের প্রতিনিধিত্ব করার নয়, বরং তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার নর্ম অর্জনের।
অলিম্পিয়াডে ভালো পারফরম্যান্স তার রেটিং বাড়াবে, নর্ম সংগ্রহ করবে এবং গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্নের আরও কাছে নিয়ে যাবে। এটা শুধু নোশিনের জন্য নয়—পুরো বাংলাদেশ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কারণ নোশিন শুধু একজন খেলোয়াড় নন—তিনি একটি আশা, একটি স্বপ্ন, একটি অনুপ্রেরণা। তার জয় মানে বাংলাদেশের জয়, তার স্বপ্ন মানে বাংলাদেশের স্বপ্ন।
একটি স্বপ্ন, একটি জাতি, অসীম সম্ভাবনা
নোশিন আনজুমের গল্প এখনো শেষ হয়নি—এটা সবে শুরু। টানা তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়া একটা বিশাল অর্জন, নিঃসন্দেহে। কিন্তু নোশিনের স্বপ্ন আরও বড়, তার লক্ষ্য আরও উঁচু।
তিনি হতে চান বাংলাদেশের প্রথম নারী গ্র্যান্ডমাস্টার। এবং আমরা বিশ্বাস করি, সঠিক সমর্থন ও সুযোগ পেলে তিনি সেটা করতে পারবেন। কারণ চ্যাম্পিয়নরা তৈরি হয় না—তারা নিজেরাই নিজেদের গড়ে তোলে। আর নোশিন আনজুম প্রমাণ করেছেন তিনি একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন।
দাবার বোর্ডে রানী সবচেয়ে শক্তিশালী ঘুঁটি। এবং নোশিন আনজুম বাংলাদেশের নারী দাবার সেই রানী—যিনি শুধু জিততেই জানেন না, জয়ের পাশাপাশি মানবিকতা, দলগত মনোভাব এবং বড় স্বপ্নের গুরুত্বও বোঝেন।

