কল্পনা করুন, আপনি হাসপাতালের ICU-তে শুয়ে আছেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, গর্ভের সন্তানকে নিয়ে চিন্তা, স্বামী বিদেশে, থিসিস অসম্পূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষই হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু মারজানা আক্তার দেয়নি। আর আজ, সেই মেয়েটি জাতিসংঘের মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।
মারজানার গল্প শুধু একজন মেধাবী গবেষকের নয়। এটা একজন মানুষের গল্প যিনি প্রমাণ করেছেন—পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, লক্ষ্য স্পষ্ট থাকলে এবং মানসিক শক্তি যথেষ্ট থাকলে অসম্ভব কিছু নেই।
বাংলাদেশের প্রথম: ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১০ জনের একজন
২০২৫ সালে United Nations Young Women for Biosecurity Fellowship-এর জন্য সারা বিশ্বের ১৯৩টি সদস্য দেশ থেকে মাত্র ১০ জন তরুণী নির্বাচিত হয়েছেন। মারজানা আক্তার তাদের একজন—এবং বাংলাদেশ থেকে প্রথম।
এই ফেলোশিপ আয়োজন করেছে United Nations Office for Disarmament Affairs (UNODA), Biological Weapons Convention-এর ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে। লক্ষ্য হলো জীববিজ্ঞানের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং বায়োসিকিউরিটি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি।
আগামী ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত হবে এই ফেলোশিপের সমাপনী অনুষ্ঠান, যেখানে উপস্থিত থাকবেন বিশ্বের শীর্ষ গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন মারজানা—দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
একাডেমিক যাত্রা: ছোট শহর থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চ
মারজানার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (SUST) থেকে, যেখানে তিনি Biochemistry and Molecular Biology-তে BSc সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি Bangladesh Agricultural University (BAU) থেকে Microbiology-তে MSc করেন।
তার মাস্টার্স গবেষণায় তিনি বাংলাদেশের পোলট্রিতে Chicken Infectious Anemia Virus (CIAV) নিয়ে কাজ করেন এবং দেশে প্রথমবারের মতো Genotype IIIb strain শনাক্ত করেন—ভাইরোলজি গবেষণায় এক উল্লেখযোগ্য অবদান।
তার সুপারভাইজার ছিলেন BAU-এর Microbiology and Hygiene বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন, যিনি শুধু একাডেমিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও মারজানাকে প্রতিটি বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছেন।
কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে এক অবিশ্বাস্য সংগ্রামের গল্প।
গর্ভাবস্থায় থিসিস: যে যুদ্ধ কেউ দেখেনি
মারজানা যখন তার থিসিস নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন তিনি গর্ভবতী। সকালে ক্লাস, দুপুরে ল্যাবে কাজ, রাতে থিসিস লেখা—সব কিছুই চলছিল শারীরিক অস্বস্তি সহ্য করে।
গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাসে তিনি গুরুতর শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন এবং পাঁচ দিন ICU-তে ভর্তি থাকতে হয়। সেই মুহূর্তগুলো ছিল জীবন-মরণের লড়াই।
ঠিক সেই সময়ে, তার স্বামী ইউশা আরাফ নিউজিল্যান্ডের University of Auckland-এ Biomedical Science-এ PhD করতে চলে যান। একাকী, অসুস্থ, চাপের মধ্যে—মারজানা হাল ছাড়েননি।
হারিয়ে যাওয়া সুযোগ, কিন্তু হারানো স্বপ্নও নয়
সেই সময়েই তার ল্যাব নির্বাচিত হয় জাপান সরকারের Sakura Science Exchange Programme-এর জন্য। ড. গোলজার হোসেনের নেতৃত্বে পুরো টিম Okayama University-এর Tsushima ক্যাম্পাসে গবেষণা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য যায়।
কিন্তু মারজানা যেতে পারেননি—কারণ তিনি তখনও ICU-তে।
অনেকেই হয়তো এই পরিস্থিতিতে নিজেকে ব্যর্থ ভাবতেন, স্বপ্ন ছেড়ে দিতেন। কিন্তু মারজানা জানতেন, এটা শেষ নয়, এটা একটা পরীক্ষা মাত্র।
মা হওয়া এবং থিসিস ডিফেন্স: দুই জীবনের শুরু
কয়েক মাস পর, মারজানা তার মেয়ে আনাইজার জন্ম দেন। সন্তান জন্মের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই, এখনও সম্পূর্ণ recover না হতেই, তিনি সফলভাবে তার থিসিস ডিফেন্স করেন।
মারজানা বলেন, “আমার যাত্রা কঠিন ছিল, কিন্তু আমি জানতাম যদি আমি হাল না ছাড়ি, তাহলে একদিন আমার সংগ্রাম শক্তিতে পরিণত হবে। আনাইজা আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।”
যে মা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন, সেই মা একই সাথে তার একাডেমিক স্বপ্নেরও জন্ম দিয়েছিলেন।
৯টি আন্তর্জাতিক রিসার্চ পেপার: বয়স মাত্র শুরু
অল্প বয়সেই মারজানা ইতিমধ্যে ৯টি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন স্বনামধন্য জার্নালে। তার গবেষণার ক্ষেত্র:
- Virology (ভাইরাস নিয়ে গবেষণা)
- Antimicrobial Resistance (AMR) (অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ)
- Infectious Diseases (সংক্রামক রোগ)
এই বয়সে এই পরিমাণ পাবলিকেশন অত্যন্ত বিরল এবং এটা প্রমাণ করে মারজানা শুধু ভাগ্যের উপর নির্ভর করেননি—কঠোর পরিশ্রম, ডেডিকেশন এবং পরিকল্পনা করেছেন।
স্বামীর সমর্থন: সাফল্যের পেছনে নীরব শক্তি
মারজানার স্বামী ইউশা আরাফ বলেন, “মারজানার এই অর্জন শুধু আমাদের পরিবারের জন্য নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্য। সে প্রমাণ করেছে যে সাহস, বিশ্বাস এবং কঠোর পরিশ্রম থাকলে কোনো বাধাই অতিক্রম করা যায়।”
একজন সফল মানুষের পেছনে প্রায়ই থাকে একজন সমর্থনকারী সঙ্গী। ইউশা নিজে PhD করছেন, কিন্তু দূর থেকে হলেও মারজানার পাশে ছিলেন প্রতিটি পদক্ষেপে।
তার সাফল্য সম্পর্কে মারজানা বলেন:
“UN ফেলোশিপের জন্য নির্বাচিত হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মানগুলোর একটি। আমি চাই আমাদের দেশের মেয়েরা জানুক যে কোনো অসুস্থতা, কষ্ট বা বাধা তাদের স্বপ্ন থেকে দূরে রাখতে পারে না। আমার লক্ষ্য হলো বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা।”
আপনার জন্য ৫টি শিক্ষা: মারজানার গল্প থেকে
১. পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও, প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখুন
মারজানা ICU-তে ছিলেন, জাপান যেতে পারেননি, স্বামী বিদেশে—এসব তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিজের মনোভাব, সিদ্ধান্ত, এবং কাজ।
আপনার জন্য টিপ: পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করার চেয়ে নিজের response improve করুন। “আমি কী করতে পারি?” জিজ্ঞেস করুন, “কেন আমার সাথে এটা হলো?” নয়।
২. স্বল্পমেয়াদী কষ্ট সহ্য করুন, দীর্ঘমেয়াদী লাভের জন্য
গর্ভাবস্থায় ক্লাস, ল্যাব, থিসিস—কষ্টকর ছিল। কিন্তু মারজানা জানতেন এই কষ্ট সাময়িক, কিন্তু MSc ডিগ্রি ও গবেষণা জীবনভর কাজে আসবে।
আপনার জন্য টিপ: আপনার ক্যারিয়ার, স্বাস্থ্য, স্কিল ডেভেলপমেন্ট—যেখানেই বিনিয়োগ করছেন, শর্ট-টার্ম sacrifice করতে হবে। এটাই সফলদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
৩. সঠিক মেন্টর খুঁজে নিন
অধ্যাপক ড. গোলজার হোসেন শুধু একাডেমিক সুপারভাইজার ছিলেন না, তিনি ছিলেন মেন্টর যিনি মারজানাকে মানসিকভাবেও শক্তিশালী করেছেন।
আপনার জন্য টিপ: আপনার ফিল্ডে এমন কাউকে খুঁজুন যিনি শুধু knowledge দেবেন না, inspiration ও support দেবেন। ভালো মেন্টর আপনার career growth ৫-১০ গুণ দ্রুত করতে পারে।
৪. সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করুন
মারজানার পাশে ছিলেন তার সুপারভাইজার, স্বামী, পরিবার। একাকী যুদ্ধ করা অসম্ভব নয়, কিন্তু সাপোর্ট সিস্টেম থাকলে অনেক সহজ।
আপনার জন্য টিপ: পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী—যারা আপনার স্বপ্নকে সমর্থন করে, তাদের কাছে রাখুন। Negative মানুষদের থেকে দূরে থাকুন যারা আপনার লক্ষ্যকে হাসিঠাট্টা করে।
৫. ছোট জয়গুলো উদযাপন করুন, শক্তি যোগায়
প্রতিটি পেপার পাবলিশ, প্রতিটি পরীক্ষায় পাস, প্রতিটি ছোট অগ্রগতি—এগুলোই একদিন বড় সাফল্যে পরিণত হয়।
আপনার জন্য টিপ: বড় লক্ষ্যের জন্য অপেক্ষা না করে ছোট মাইলস্টোন celebrate করুন। এটা আপনাকে motivated রাখবে এবং burnout থেকে বাঁচাবে।
মানসিক শক্তি: সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ
আপনি শেয়ার বাজারে, প্রপার্টিতে, বিজনেসে বিনিয়োগ করছেন—সব ঠিক আছে। কিন্তু মারজানার গল্প শেখায়, সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হলো নিজের mental strength-এ।
শারীরিকভাবে দুর্বল থাকলেও মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকলে আপনি:
- কঠিন সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন
- হাল ছাড়বেন না যখন সবাই ছেড়ে দেয়
- সমস্যাকে সুযোগে রূপান্তর করতে পারবেন
- দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবেন
মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপায়:
- নিয়মিত ধ্যান বা mindfulness চর্চা করুন
- কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রশ্ন করুন: “এখান থেকে আমি কী শিখতে পারি?”
- Inspirational গল্প পড়ুন (যেমন মারজানার গল্প)
- ছোট লক্ষ্য অর্জন করে confidence তৈরি করুন
- শরীর সুস্থ রাখুন—ভালো ঘুম, ব্যায়াম, খাবার
স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে সেতু: কঠোর পরিশ্রম
মারজানার গল্পে কোনো magic নেই, overnight success নেই। আছে শুধু:
- লক্ষ্য স্পষ্ট রাখা
- প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া
- বাধা এলেও থেমে না যাওয়া
- সাহায্য নেওয়া যখন প্রয়োজন
- নিজের উপর বিশ্বাস রাখা
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য বার্তা
মারজানা প্রমাণ করেছেন যে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যাওয়া সম্ভব। আপনার জন্ম কোন এলাকায়, পরিবার কতটা সম্পদশালী, আপনি ঢাকায় না গ্রামে—এসব secondary।
Primary হলো:
- আপনার স্বপ্ন কতটা বড়
- আপনার পরিশ্রম কতটা ধারাবাহিক
- আপনার মানসিক শক্তি কতটা দৃঢ়
মারজানা সিলেট থেকে শুরু করেছেন, আজ জেনেভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আপনিও পারবেন।
ICU থেকে UN—এক অবিশ্বাস্য যাত্রা
মারজানা আক্তারের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জীবন কখনোই সহজ পথ দেখায় না। কিন্তু যারা কঠিন পথেও হাঁটতে রাজি, তাদের জন্য অপেক্ষা করে অসাধারণ সব সাফল্য।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যে মেয়েটি ভাবছিল “আমি কি পারব?”, সেই মেয়েটি আজ পুরো বিশ্বকে বলছে, “হ্যাঁ, আমি পেরেছি। তুমিও পারবে।”
আপনার স্বপ্ন যতই বড় হোক, পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক—মারজানার গল্প মনে রাখবেন। ICU থেকে UN—এটা শুধু একটা headline নয়, এটা একটা প্রমাণ যে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
আপনার সাফল্যের গল্পও শেয়ার করুন আপনিও কি কোনো অসাধারণ অর্জন, উদ্ভাবন বা অনুপ্রেরণামূলক গল্পের অধিকারী? আপনার SpikeStory আমাদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার সাফল্যের কাহিনী অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।
ইমেইল করুন: info@spikestory.com