মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৮, ২০২৫
HomeInspirationWonder Womanইতিহাস গড়লেন সুবহা রহমান: কে এই নারী, যিনি হলেন বাংলাদেশের প্রথম AFC...

ইতিহাস গড়লেন সুবহা রহমান: কে এই নারী, যিনি হলেন বাংলাদেশের প্রথম AFC ম্যাচ কমিশনার?

গল্পটা শুরু হয়েছিল বাস্কেটবলের কোর্টে। কাঠ বাধানো মেঝের ওপর বল ড্রিবল করার সেই পরিচিত শব্দ, প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভেঙে পয়েন্ট তুলে আনার ক্ষিপ্রতা—এটাই ছিল সুবহা রহমানের চেনা জগত। আর আজ, সেই সুবহা রহমানই দাঁড়িয়ে আছেন সবুজ ঘাসের বিশাল এক স্টেডিয়ামে, যেখানে হাজার হাজার দর্শকের চিৎকারের মাঝে দুটো দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়।

যিনি ছোটবেলায় বাস্কেটবলকে ভালোবেসে কোর্টে দাপিয়ে বেড়াতেন, তিনিই আজ দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় লিখলেন।

বাস্কেটবলের মাঠে যার শুরু

ছোটবেলায় সুবহা রহমান বাস্কেটবল খেলতেন। ঢাকার কোনো এক স্কুল মাঠে কোর্টে দৌড়াতেন, বল ছুড়তেন, জিততেন। বাস্কেটবলের দুনিয়া তাকে ভালোবেসে ঘিরে রেখেছিল। স্কুল টিমে খেলতেন, ইন্টার-স্কুল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। খেলার মাঠই ছিল তার পছন্দের জায়গা।

কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেননি সুবহা। তার আগ্রহ ছিল ভিন্ন দিকে। পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন, স্বপ্ন দেখতেন উচ্চশিক্ষার। সেই স্বপ্ন পূরণ হলো যখন ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পেলেন মাস্টার্স করার জন্য।

বিদেশে গিয়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার ধরন—সবকিছুই ছিল ভিন্ন। কিন্তু সুবহা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পড়াশোনায় মনোযোগ দিলেন, ভালো ফলাফল করলেন। কিন্তু মনের কোণে ছিল দেশে ফিরে যাওয়ার টান। অনেকেই বিদেশে সেটেল হওয়ার চেষ্ট করেন, কিন্তু সুবহা ঠিক করলেন দেশে ফিরবেন এবং দেশের জন্যই কাজ করবেন।

জীবনের মোড় ঘুরে গেল যখন ইংল্যান্ড থেকে মাস্টার্স শেষ করে ৫ বছর আগে তিনি যোগ দিলেন দক্ষিণ এশীয় ফুটবল ফেডারেশন (সাফ)-এ। প্রথমে হয়তো ভেবেছিলেন, এটা একটা চাকরি মাত্র। একটা ভালো সংস্থা, ভালো পরিবেশ, শেখার সুযোগ আছে। কিন্তু কাজের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলের প্রতি জন্ম নিল এক অদম্য টান।

ফুটবল স্টেডিয়ামের উত্তেজনা, লাখো মানুষের চিৎকার, খেলোয়াড়দের নিঃশ্বাস বন্ধ করা লড়াই—এসব যেন তার রক্তে মিশে গেল। প্রতিটি ম্যাচে গিয়ে মুগ্ধ হতেন খেলার সৌন্দর্যে। বুঝতে পারলেন, ফুটবল শুধু ২২ জন খেলোয়াড়ের খেলা নয়, এটি লাখো মানুষের আবেগ, স্বপ্ন এবং আনন্দের উৎস। বাস্কেটবল খেলোয়াড় সুবহা রহমান হয়ে উঠলেন ফুটবলের একজন নিবেদিতপ্রাণ সেবক।

পরিবার: যাদের সমর্থন ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি

বাবা মশিউর রহমান, মা জিন্নাত রহমান। তিন কন্যার সংসারে সুবহা সবার বড়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে যিনি পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এলেন নতুন স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু ফুটবলে ক্যারিয়ার? একজন মেয়ে ফুটবলের সাথে জড়িত হবে প্রশাসনিকভাবে? আমাদের সমাজে এটা খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না।

কিন্তু পরিবার ছিল সুবহার পেছনে। বাবা-মা বুঝেছিলেন, তাদের মেয়ে কোনো সাধারণ পথে হাঁটতে চান না। তিনি চান নতুন কিছু করতে, নতুন ক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করতে। আর সেই স্বপ্ন পূরণে তারা হয়ে উঠলেন সুবহার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট সিস্টেম।

“পরিবারের সমর্থন না পেলে এতদূর আসতে পারতাম না,” মনের কথা খুলে বলেন সুবহা। “অনেক সময় যখন মন ভেঙে যেত, যখন মনে হতো হয়তো পারব না, তখন বাবা-মায়ের কথাই আমাকে এগিয়ে দিত।”

দুই ছোট বোনও ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। বড় বোন হিসেবে সুবহা চাইতেন তাদের জন্য একটা উদাহরণ তৈরি করতে। প্রমাণ করতে চাইতেন যে মেয়েরা যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হতে পারে, শুধু দরকার সঠিক মনোভাব এবং কঠোর পরিশ্রম।

সাফে কাজের অভিজ্ঞতা: প্রতিটি দিন ছিল শিক্ষার

সাফের শুরু থেকেই কাজ করছেন তিনি। এখন সাফের হেড অব হিউম্যান রিসোর্স, প্ল্যানিং এবং ম্যানেজার কম্পিটিশন। এই পদের গুরুত্ব বোঝা যায় যখন জানা যায়, প্রায় সব ধরনের ফুটবল টুর্নামেন্টে তার হাত রয়েছে।

প্রথম দিকে ছোট ছোট কাজ দিয়ে শুরু করেছিলেন। ডকুমেন্টেশন, কোঅর্ডিনেশন, টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু প্রতিটি কাজ করতেন পূর্ণ নিষ্ঠায়। ছোট কোনো কাজ নেই—এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন। ধীরে ধীরে দায়িত্ব বাড়তে লাগল। বয়সভিত্তিক সাফ থেকে শুরু করে সিনিয়র সাফ পর্যন্ত, প্রায় ৪ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা হলো।

প্রতিটি টুর্নামেন্ট ছিল নতুন শিক্ষার সুযোগ। কীভাবে একটি বড় ইভেন্ট ম্যানেজ করতে হয়, কীভাবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে কাজ করতে হয়, কীভাবে চাপের মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়—সবকিছু শিখলেন হাতে-কলমে।

২০২২ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল অবিস্মরণীয়। সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মাঠে যখন বাংলাদেশের মেয়েরা আনন্দে লাফাচ্ছিল, তখন সুবহার চোখেও জল এসেছিল। মনে হয়েছিল, এই আনন্দে তিনিও একটা ছোট অংশীদার।

২০২৪ সালে ঢাকায় যখন আবারও সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ হলো এবং বাংলাদেশ আবারও চ্যাম্পিয়ন হলো, তখন সুবহা ছিলেন অন্যতম কো-অর্ডিনেটর। নিজের দেশে, নিজের মাটিতে এমন একটা সফল টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পেরে গর্ব লেগেছিল।

আর এই সব অভিজ্ঞতাই কাজে লেগেছে ম্যাচ কমিশনার হওয়ার পথে।

৩০ বছর বয়সে ৩০টি দেশকে পেছনে ফেলে

ম্যাচ কমিশনার হতে হলে বয়স হতে হয় ন্যূনতম ৩০ বছর। এটি এএফসি-র একটি নিয়ম। কারণ ম্যাচ কমিশনার হওয়ার জন্য দরকার পরিপক্বতা, অভিজ্ঞতা এবং দায়িত্ববোধ। একজন ২০ বছরের তরুণ বা তরুণী হয়তো খুব দক্ষ হতে পারেন, কিন্তু একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচের সব দিক সামলানোর জন্য দরকার জীবনের অভিজ্ঞতা।

সুবহা রহমান এবছরই ৩০-এর কোটা পূরণ করেছেন। বয়স হওয়ার সাথে সাথেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন তিনি। অনেকেই অপেক্ষা করেন, ভাবেন আরেকটু অভিজ্ঞতা হোক, তারপর চেষ্টা করব। কিন্তু সুবহা ভাবলেন, সময় নষ্ট না করে এখনই চেষ্টা করা উচিত।

প্রথমবারই আবেদন করলেন এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) ম্যাচ কমিশনার পরীক্ষায়। আবেদনের প্রক্রিয়া ছিল জটিল। সিভি জমা দিতে হয়, রেকমেন্ডেশন লাগে, অভিজ্ঞতার প্রমাণ দিতে হয়। সবকিছু ঠিকঠাক হলে তবেই পরীক্ষায় বসার সুযোগ মেলে।

গত আগস্টে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এএফসি-র কার্যালয়ে বসলেন পরীক্ষা। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিলেন প্রার্থীরা। জাপান, কোরিয়া, চীন, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত—ফুটবলে উন্নত এসব দেশের অভিজ্ঞ মানুষরা ছিলেন সেখানে। অনেকেরই ১০-১৫ বছরের অভিজ্ঞতা।

পরীক্ষার বিষয়বস্তু ছিল বিশাল। ফুটবলের নিয়ম-কানুন, ম্যাচ ম্যানেজমেন্ট, প্রশাসনিক দক্ষতা, সংকট ব্যবস্থাপনা, রিপোর্ট লেখা—সবকিছুর ওপরই ছিল কঠিন পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা, কেস স্টাডি—সব মিলিয়ে ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া।

“পরীক্ষার সময় খুব নার্ভাস ছিলাম,” স্বীকার করেন সুবহা। “ভাবছিলাম, এত অভিজ্ঞ মানুষের সাথে প্রতিযোগিতা করছি, পারব তো? কিন্তু তারপর মনে হলো, না, আমি যথেষ্ট প্রস্তুত। আমার অভিজ্ঞতা হয়তো কম, কিন্তু আমার মেধা, আমার নিষ্ঠা কোনো অংশে কম নয়।”

আর ফলাফল? প্রথমবারেই পাশ! মেধা, দক্ষতা যাচাই-বাছাইয়ের কঠিন পরীক্ষায় এশিয়ার অনেক অভিজ্ঞ প্রার্থীকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন বাংলাদেশের এই তরুণী। প্রমাণ হলো, বয়স বা অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় হলো মেধা, মনোভাব এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠা।

কুয়ালালামপুরের সেই কঠিন পরীক্ষা

এই পদের জন্য যোগ্যতার মানদণ্ডও খুব কড়া। বয়স কমপক্ষে ৩০ বছর হতে হয়। সুবহা রহমান এবছরই ৩০-এর কোটা পূরণ করেছেন। আর প্রথমবার আবেদন করেই বাজিমাত করলেন।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এএফসি সদর দপ্তরের সেই পরীক্ষার হলটা ছিল পিনপতন নীরবতার। এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বাঘা বাঘা প্রার্থীরা বসে আছেন। পরীক্ষাটা শুধু ফুটবলের নিয়মকানুন মুখস্থ বলার নয়; এটা ছিল প্রজ্ঞা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আর সংকট ব্যবস্থাপনার পরীক্ষা। হাজার হাজার পাতার রুলবুক, প্রটোকল, লজিস্টিকস—সবকিছু ছিল এই পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

সুবহা সেই কঠিন পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। মেধা, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার সেই বৈশ্বিক মানদণ্ডে তিনি এশিয়ার অনেক দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।

কেন এই অর্জন এতটা গুরুত্বপূর্ণ?

বাংলাদেশে নারী ফুটবলের জাগরণটা আমরা দেখছি মাঠের সবুজ গালিচায়। মারিয়া মান্ডা, সাবিনা খাতুনরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেখিয়েছেন, মেয়েরা ট্রফি জিততে পারে। জয়া চাকমারা রেফারি হয়ে ফিফা ব্যাজ পরে বাঁশি হাতে মাঠ শাসন করছেন।

কিন্তু এতদিন পর্দার আড়ালে, খেলার মূল প্রশাসনে, ক্ষমতার কেন্দ্রে নারীদের বিচরণ ছিল সীমিত।

মাহফুজা আক্তার কিরণ প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ফিফার কাউন্সিল মেম্বার হয়ে সেই সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী দরজাটা খুলেছিলেন। আর এবার, সুবহা রহমান ম্যাচ কমিশনার হয়ে সেই নীতি ‘মাঠে প্রয়োগ’ করার দরজাটা খুললেন।

তিনি প্রমাণ করলেন, মেয়েরা শুধু ফুটবল খেলতেই পারে না, ফুটবল ‘চালাতেও’ পারে।

যে মানুষগুলোকে একসময় শুনতে হতো “ফুটবলে মেয়েদের কী কাজ”, সুবহা রহমান আজ সেইসব প্রশ্নের জীবন্ত জবাব। তিনি দেখিয়ে দিলেন, ফুটবলের নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন—সবকিছুতেই মেয়েরা অবদান রাখতে পারে।

তার এই অর্জন শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়; এটা একটা সামাজিক ট্যাবু ভাঙার গল্প। এটা সেইসব মেয়েদের জন্য এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা, যারা খেলাধুলায় আসতে চায়, কিন্তু ‘লোকে কী বলবে’ বা ‘এটা মেয়েদের কাজ নয়’—এইসব কথা ভেবে পিছিয়ে যায়।

সুবহা রহমান আজ একটি মাইলফলক। তিনি সেই পথিকৃৎ, যিনি দেখালেন—যোগ্যতা, অদম্য ইচ্ছা আর নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকলে বাস্কেটবলের কোর্ট হোক বা ফুটবলের প্রশাসনিক টেবিল, নারীরা সবখানেই সেরা হতে পারে।

তিনি এখন শুধু সাফের অফিসে ফাইল সই করবেন না, তিনি এশিয়ান ফুটবলের বড় বড় টুর্নামেন্টে ম্যাচ কমিশনারের ব্লেজার পরে পুরো ইভেন্টের দায়িত্ব নেবেন। বাংলাদেশের পতাকা হাতে তিনি বসবেন সেই ক্ষমতার টেবিলে, যেখানে বসে খেলার নিয়মকানুন আর ভাগ্য নির্ধারিত হয়।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular