একবার ভাবুন তো—আপনার শরীরই যদি তার ভেতরের ভাঙাচোরা, পুরনো, অপ্রয়োজনীয় অংশগুলোকে খেয়ে ফেলত? শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এটা সত্যি। এবং এই প্রক্রিয়ার নাম অটোফ্যাজি—যার আক্ষরিক অর্থ, “নিজেকে খাওয়া”।
এই প্রক্রিয়াটি প্রথম শুনলে হয়তো ভয় লাগতে পারে, কিন্তু আসলে এটি আমাদের শরীরের জন্য এক আশীর্বাদ। জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওসুমি যখন এর রহস্য উন্মোচন করেন, তখন বিজ্ঞানজগতে আলোড়ন উঠেছিল। এমনকি, ২০১৬ সালে তিনি এই গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কারও পান। আজ এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বিশ্বের লাখো মানুষের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অটোফ্যাজি কীভাবে কাজ করে?
আমাদের শরীর প্রতিনিয়ত কোষ তৈরি করছে, আবার পুরনো কোষগুলো ধ্বংসও করছে। কিন্তু সব কোষই তো একেবারে মারা যায় না—অনেক সময় কোষের ভেতর ক্ষতিগ্রস্ত অংশ জমে থাকে: যেমন, ভাঙা মাইটোকন্ড্রিয়া, ত্রুটিপূর্ণ প্রোটিন, কিংবা এমন উপাদান যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
অটোফ্যাজি হলো শরীরের এক প্রাকৃতিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা। এটি এমন কোষগুলোকে “প্যাকেট করে” ধ্বংস করে এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য উপাদানগুলো পুনরায় শরীরের কাজে লাগায়। একদম রিসাইক্লিং সিস্টেমের মতো!
এই প্রক্রিয়া সাধারণত তখনই সক্রিয় হয়, যখন আমরা দীর্ঘ সময় ধরে না খেয়ে থাকি—১৪ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত। তখন শরীর বাইরের খাদ্য না পেয়ে ভেতরের “অপ্রয়োজনীয় সম্পদ” থেকেই শক্তি তৈরি করে।
অটোফ্যাজি কেন জরুরি?
বিশেষজ্ঞদের মতে, অটোফ্যাজি কেবল দেহের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নয়, বরং এটি অনেক বড় বড় রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
✅ ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক: অটোফ্যাজি কোষের ভেতরের অসংগঠিত ও ক্ষতিকর উপাদান সরিয়ে দেয়, যা ভবিষ্যতে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারত।
✅ অ্যালঝেইমার ও নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ প্রতিরোধে সহায়ক: মস্তিষ্কের কোষে জমে থাকা ক্ষতিকর প্রোটিন দূর করতে অটোফ্যাজি ভূমিকা রাখে।
✅ বয়স ধরে রাখে: যেহেতু অটোফ্যাজি কোষ মেরামত ও পুনর্গঠনে সাহায্য করে, তাই বয়সজনিত দুর্বলতাও ধীরে আসে।
✅ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: সুস্থ কোষগুলো সক্রিয় থাকে এবং রোগপ্রতিরোধে ভালো কাজ করে।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং: অটোফ্যাজির জ্বালানি
অনিয়মিত উপবাস বা Intermittent Fasting হলো এমন এক খাদ্যাভ্যাস, যেখানে আপনি নির্দিষ্ট একটা সময় না খেয়ে থাকেন এবং বাকি সময়ে খান।
সবচেয়ে প্রচলিত প্যাটার্ন হলো 16:8, অর্থাৎ দিনে ১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা এবং ৮ ঘণ্টার মধ্যে খাবার খাওয়া। এই দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার সময়ই শরীর অটোফ্যাজি প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে।
উদাহরণস্বরূপ:
আপনি রাত ৮টায় রাতের খাবার খেলেন, পরদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত না খেলে আপনি ১৬ ঘণ্টা উপবাসে থাকলেন। এরপর দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে খাবার গ্রহণ করলে এটি একটি সম্পূর্ণ চক্র হয়ে যায়।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে উপবাস ও অটোফ্যাজি
বাংলাদেশে রোজা রাখার ধর্মীয় অভ্যাস আমাদের শরীরকে অটোফ্যাজির অনেকটাই কাছাকাছি নিয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখলে দেহের ভেতরের বিপাক প্রক্রিয়ায় বেশ পরিবর্তন আসে, যার মধ্যে অটোফ্যাজিও রয়েছে।
তবে এখানেও কিছু শর্ত আছে—যদি রোজার সময় অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, মিষ্টি বা পরিমাণের অতিরিক্ত খাবার খাওয়া হয়, তাহলে অটোফ্যাজির প্রভাব কমে যায়।
সতর্কতা ও পরামর্শ
অটোফ্যাজির সুবিধা নিতে গিয়ে অনেকেই হঠাৎ করে উপবাস শুরু করে দেন। তবে মনে রাখবেন, এটি সবার জন্য উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে যাদের:
- ডায়াবেটিস আছে
- গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মা
- উচ্চ রক্তচাপ বা লো ব্লাড সুগারের সমস্যা রয়েছে
- শিশু-কিশোর বা বৃদ্ধ বয়স
তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা দীর্ঘ উপবাস বিপজ্জনক হতে পারে।
নিজেকে ভালোবাসার এক অনন্য উপায়
আমরা প্রতিদিন শরীরের বাইরের যত্ন নিতে যতটা সময় দেই, শরীরের ভেতরের পরিচর্যায় অনেক সময়ই অবহেলা করি। অথচ এই ভেতরের সাফ-সুতরো রাখার প্রাকৃতিক উপায় হলো অটোফ্যাজি।
অটোফ্যাজি আমাদের দেহকে নিজের মতো করে মেরামত করার সুযোগ দেয়। এটি যেন এক আত্মরক্ষার উপায়, এক নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাই জীবনধারায় ছোট্ট একটু পরিবর্তন—যেমন অনিয়মিত উপবাস বা হালকা খাবার—আমাদের শরীরকে অনেক বড় উপকার দিতে পারে।
স্মরণীয় কথা, ভালো থাকার জন্য সবসময় ওষুধ নয়, অনেক সময় *“না খাওয়া”*ই হতে পারে সবচেয়ে বড় ঔষধ।
*এই প্রতিবেদনটি শুধু তথ্যভিত্তিক। কোনো নতুন খাদ্যাভ্যাস শুরু করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।