back to top
শুক্রবার, নভেম্বর ২১, ২০২৫
HomeProductivityPersonal Developmentশুধু দৌঁড়াচ্ছেন, কিন্তু গন্তব্য জানা নেই? জাপানি এই Ikigai ফর্মুলাটি কাজে লাগান

শুধু দৌঁড়াচ্ছেন, কিন্তু গন্তব্য জানা নেই? জাপানি এই Ikigai ফর্মুলাটি কাজে লাগান

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কি আপনার মনে হয় আজকে আবার একই রুটিন? অফিস, ট্রাফিক, বস্‌-এর বকুনি, বাসায় ফিরে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা আর ঘুম? সপ্তাহান্তে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার সেই একই চক্র?

মাঝেমধ্যে কি ভাবেন, “আমি কেন এসব করছি? লাইফের আসল মানে কী? আমি কি সত্যিই খুশি?” যদি এই প্রশ্নগুলো আপনার মাথায় ঘুরপাক খায়, তাহলে আপনি একা নন। ঢাকার হাজারো মানুষ এই একই সংকটে ভুগছেন। ক্যারিয়ার আছে, টাকা আছে, কিন্তু সেই গভীর তৃপ্তি, সেই অর্থপূর্ণ জীবনের অনুভূতি নেই।

জাপানিরা এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন শত শত বছর আগে। তাদের একটি ধারণা আছে যার নাম “Ikigai” (উচ্চারণ: ই-কি-গাই)। এই শব্দটি দুটি জাপানি শব্দের সমন্বয়ে তৈরি – “iki” (生き) অর্থ “জীবন” এবং “gai” (甲斐) অর্থ “মূল্য” বা “উদ্দেশ্য”। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, Ikigai হলো আপনার “বেঁচে থাকার কারণ”।

গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা তাদের Ikigai খুঁজে পেয়েছেন, তারা শুধু বেশি খুশিই না, তারা বেশি দিনও বাঁচেন! জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শতবর্ষী মানুষ বাস করেন, আর তাদের দীর্ঘায়ুর পেছনে অন্যতম রহস্য হলো Ikigai।

Ikigai কী এবং কেন এটি এত শক্তিশালী?

১৯৬৬ সালে জাপানি মনোচিকিৎসক মিয়েকো কামিয়া তার বই “On the Meaning of Life”-এ Ikigai ধারণাটি প্রথম জনপ্রিয় করেন। কিন্তু এর শিকড় আরও গভীরে। Ikigai ধারণাটি জাপানের হেইয়ান যুগে (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) শুরু হয়েছিল।

Ikigai শুধু একটা ক্যারিয়ার গোল বা সাফল্যের সংজ্ঞা নয়। এটা আরও গভীর। জাপানি মনোবিজ্ঞানী মিচিকো কুমানোর মতে, Ikigai হলো এমন একটি সুখের অনুভূতি যা আপনি যখন এমন কাজে নিবেদিত হন যা আপনি ভালোবাসেন এবং যা আপনাকে পরিপূর্ণতার অনুভূতি দেয়।

আর এটা শুধু তত্ত্বকথা নয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে Ikigai হৃদরোগ কমায়, মৃত্যুহার হ্রাস করে, উদ্বেগ দূর করে এবং মানসিক দৃঢ়তা বাড়ায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে Ikigai জাপানি বয়স্কদের মধ্যে কার্যক্ষমতা হ্রাস এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

Ikigai-এর চারটি স্তম্ভ: ভেন ডায়াগ্রাম

আধুনিক সময়ে Ikigai বুঝতে সবচেয়ে সহজ উপায় হলো চারটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। আমেরিকান উদ্যোক্তা মার্ক উইন একটি ভেন ডায়াগ্রাম তৈরি করেছিলেন যা Héctor García এবং Francesc Miralles-এর ২০১৬ সালের বেস্টসেলার বই “Ikigai: The Japanese Secret to a Long and Happy Life”-এ জনপ্রিয় হয়। এই ডায়াগ্রামে চারটি বৃত্ত রয়েছে যা একে অপরকে ছেদ করে:

১. আপনি কী ভালোবাসেন? (What You Love)

এটা হলো আপনার প্যাশন। কোন কাজ করতে আপনি সময়ের হিসাব ভুলে যান? কোন জিনিস নিয়ে ভাবলে আপনার চোখ জ্বলে ওঠে?

উদাহরণ: ঢাকার মোহাম্মদপুরের একজন তরুণ রাফি সবসময় ছবি আঁকতে ভালোবাসত। ছোটবেলা থেকেই খাতার পাতায় আঁকাআঁকি করত। বড় হয়ে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ল, কিন্তু মনটা পড়ে থাকত আর্টে।

২. আপনি কীসে দক্ষ? (What You Are Good At)

এটা আপনার দক্ষতা এবং প্রতিভা। কোন কাজটা আপনি অন্যদের চেয়ে ভালো করতে পারেন? কোন বিষয়ে মানুষ আপনার কাছে পরামর্শ চায়?

উদাহরণ: রাফি দেখল যে সে অন্যদের চেয়ে ডিজিটাল ইলাস্ট্রেশন ভালো করতে পারে। বন্ধুরা তাকে পোস্টার, লোগো ডিজাইন করতে বলত।

৩. পৃথিবীর কী প্রয়োজন? (What The World Needs)

এটা সমাজের চাহিদা। কোন সমস্যা সমাধান করলে মানুষের উপকার হবে? আপনি কীভাবে অন্যের জীবনে মূল্য যোগ করতে পারেন?

উদাহরণ: রাফি লক্ষ্য করল যে বাংলাদেশি ব্যবসাগুলো মানসম্পন্ন গ্রাফিক্স ডিজাইনের জন্য ভারত বা পাকিস্তানের ডিজাইনারদের কাছে যাচ্ছে। দেশি ডিজাইনারদের একটা ঘাটতি আছে।

৪. আপনি কীসের জন্য পারিশ্রমিক পেতে পারেন? (What You Can Be Paid For)

এটা আপনার পেশাগত দিক। কোন কাজটা করে আপনি টাকা আয় করতে পারবেন? কোন দক্ষতার বাজারমূল্য আছে?

উদাহরণ: রাফি বুঝল যে গ্রাফিক্স ডিজাইনের একটা বড় মার্কেট আছে বাংলাদেশে এবং এটা দিয়ে ভালো আয় করা সম্ভব।

যখন এই চারটি বৃত্ত একসাথে মিলিত হয়, ঠিক মাঝখানে যে বিন্দুটি তৈরি হয় – সেটাই হলো আপনার Ikigai! রাফির ক্ষেত্রে এটা ছিল “বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলোর জন্য সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক ডিজাইন তৈরি করা”।

কীভাবে আপনার Ikigai খুঁজে পাবেন?

ধাপ ১: নিজের সাথে সৎ কথোপকথন করুন

একটা খাতা নিন। চারটি বৃত্ত আঁকুন। প্রতিটি বৃত্তে আপনার উত্তর লিখুন। কোনো ফিল্টার ছাড়াই, কোনো বিচার ছাড়াই লিখুন যা মনে আসে।

ধাপ ২: ছোট ছোট পরীক্ষা চালান

আপনার মনে হয় যে জিনিসগুলো আপনার Ikigai হতে পারে, সেগুলো একটু করে চেষ্টা করুন। উইকএন্ডে প্রজেক্ট শুরু করুন। ফ্রিল্যান্সিং করুন। ভলান্টিয়ার কাজ করুন।

ধাপ ৩: মানুষের সাথে কথা বলুন

আপনার বন্ধু, পরিবার, সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করুন: “আমি কোন কাজটা সবচেয়ে ভালো করি?” তাদের উত্তর আপনাকে অবাক করতে পারে।

ধাপ ৪: ধৈর্য ধরুন

লেখক Ken Mogi ব্যাখ্যা করেছেন যে Ikigai এমন কিছু হতে পারে যার জন্য আপনি পারিশ্রমিক পান না। যেমন, আপনি যদি ছবি আঁকতে ভালোবাসেন কিন্তু এর জন্য টাকা না পান, তবুও সেটা আপনার Ikigai হতে পারে। এবং মনে রাখবেন, আপনার Ikigai সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে এবং বয়সের সাথে নতুন রূপ নিতে পারে।

Ikigai নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণা

Ikigai মানে চাকরি ছেড়ে দেওয়া

না! Ikigai আপনার বর্তমান কাজেও খুঁজে পেতে পারেন। হয়তো আপনার কাজের একটা অংশ আছে যা আপনি ভালোবাসেন – সেটাকে আরও বাড়িয়ে দিন। বা আপনার চাকরির বাইরে একটা হবি বা প্যাশন প্রজেক্ট শুরু করুন।

Ikigai পাওয়া মাত্র সবকিছু পারফেক্ট হয়ে যাবে

Ikigai কোনো জাদুকাঠি নয়। এটা একটা যাত্রা, গন্তব্য নয়। আপনি আপনার Ikigai খুঁজে পেলেও চ্যালেঞ্জ থাকবে, কঠিন সময় আসবে। কিন্তু পার্থক্য হলো আপনি জানবেন কেন আপনি এটা করছেন।

Ikigai সবসময় টাকা দিয়ে মাপতে হবে

Ikigai এমন কিছু হতে পারে যার জন্য আপনি অর্থ পান না। আপনি যদি গিটার বাজাতে ভালোবাসেন, এমনকি আপনি খারাপভাবে বাজান, তবুও এটি আপনার Ikigai হতে পারে।

আপনি হয়তো ভাবছেন, “এত কিছু ভাবার সময় কোথায়? অফিসের টার্গেট, বাসার দায়িত্ব, বিল পেমেন্ট – এসব নিয়েই তো ব্যস্ত থাকি।” কিন্তু ভাবুন তো, এই ব্যস্ততার মাঝে কি আপনি সত্যিই বেঁচে আছেন, নাকি শুধু টিকে আছেন?

জীবন একবারই পাওয়া যায়। সেই জীবনটা যদি অর্থহীন মনে হয়, যদি প্রতিদিন জেগে উঠতে ভারী লাগে, যদি মনে হয় শুধু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন কিন্তু আনন্দ নেই – তাহলে সময় এসেছে আপনার Ikigai খুঁজে বের করার।

আজই শুরু করুন। একটা খাতা নিন। চারটা বৃত্ত আঁকুন। লিখতে শুরু করুন। উত্তরগুলো এক দিনে আসবে না, কিন্তু যাত্রাটা শুরু করুন। কারণ যে মুহূর্তে আপনি আপনার Ikigai খুঁজে পাবেন, জীবন আর একই থাকবে না। প্রতিটা সকাল হবে নতুন সম্ভাবনায় ভরা। প্রতিটা দিন হবে অর্থপূর্ণ।

আপনার Ikigai কী? খুঁজে বের করুন এবং একটা অর্থপূর্ণ, আনন্দময়, উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন যাপন শুরু করুন। কারণ লাইফ টু শর্ট টু বি মিসারেবল – জীবন খুব ছোট হতাশায় কাটানোর জন্য!

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular