সাভারের সবুজ প্রাঙ্গণে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একটি বিশেষ আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। রাতের আকাশে তারার মতোই উজ্জ্বল এক সংবাদ এসেছে – তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান লোপা আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় (IAAC) গোল্ড মেডেল জিতেছেন। কিন্তু এই স্বর্ণালী সাফল্যের পেছনে রয়েছে এক অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প, যা প্রমাণ করে – স্বপ্ন দেখলে এবং কঠোর পরিশ্রম করলে আকাশের তারাও নাগালের মধ্যে।
ব্রোঞ্জ থেকে সোনা: এক বছরের অসাধারণ যাত্রা
গল্পটি শুরু হয় ২০২৪ সালে। প্রথমবারের মতো IAAC প্রতিযোগিতার কথা শুনে নুসরাত। নতুন অভিজ্ঞতা, অজানা পথ – কিন্তু সাহস ছিল প্রবল। সিনিয়র ভাই-বোনদের সাপোর্টে প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন। ফলাফল? ব্রোঞ্জ মেডেল।
অনেকের কাছে এটাই বিরাট সাফল্য। কিন্তু নুসরাতের চোখে জ্বলছিল আরও বড় স্বপ্ন। তিনি বলেন, “গতবার ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করার পর আমি থেমে যাইনি। নিজের ইচ্ছাশক্তিকে আরও দৃঢ় করেছি এবং আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি।”
এই মানসিকতাই তাকে আলাদা করেছে। ২০২৫ সালে আবার প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেন। এবার লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার – গোল্ড মেডেল। এক বছরের নিরলস পরিশ্রম, গভীর অধ্যয়ন আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে সেই স্বপ্ন বাস্তব হলো।
IAAC: বিশ্বব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞানের অলিম্পিয়াড
আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান প্রতিযোগিতা (IAAC) স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। প্রতিটি সমস্যার জন্য ৫ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকে এবং প্রাক-চূড়ান্ত রাউন্ডে উত্তীর্ণ হতে বয়স অনুযায়ী ১৫, ১৭ বা ২০ পয়েন্ট অর্জন করতে হয়। শীর্ষ পারফরমাররা ১,৪০০ ডলার পর্যন্ত পুরস্কার পান, যার মধ্যে রয়েছে নগদ পুরস্কার এবং মহাকাশচারী ফ্র্যাঙ্ক ডি উইন ও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের স্বাক্ষরিত টেলিস্কোপ।
এই প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা এবং তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া।
জাবির অভূতপূর্ব সাফল্য
এবছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা সত্যিই গর্বের। নুসরাতের গোল্ড মেডেলের পাশাপাশি ৭ জন সিলভার এবং ২৪ জন ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন। মোট ৩২ জন পদকপ্রাপ্ত – এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত প্রচেষ্টা ও দল হিসেবে কাজ করার ফল।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ রাসেল হোসেন “সেরা ফাইনালিস্ট সুপারভিশন” এর জন্য শিক্ষক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এম এ সাইফ (৫০ ব্যাচ) পেয়েছেন অ্যাম্বাসেডর অ্যাওয়ার্ড। এটি প্রমাণ করে যে জাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ শুধু শিক্ষার্থী তৈরিতে নয়, আন্তর্জাতিক মানের নেতৃত্ব তৈরিতেও এগিয়ে।
অ্যাস্ট্রোনমি ক্লাব: গবেষণার সূতিকাগার
নুসরাত শুধু একাডেমিক পড়াশোনায়ই সীমাবদ্ধ থাকেননি। জাবি অ্যাস্ট্রোনমি ক্লাবের গবেষণা ও প্রকল্প টিমের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মেম্বার হিসেবে কাজ করেছেন। এই ক্লাবটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।
এখানেই তার জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি প্রেম গড়ে ওঠে। সিনিয়র ভাই-বোনদের গাইড করার সংস্কৃতি তাকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, “আমাদের বড় ভাই-আপুরা যেভাবে সাপোর্ট ও গাইড করেছিলেন, তাতে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি আমি এখানে নতুন।”
বিভাগীয় সহায়তা: সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি
নুসরাতের সাফল্যের পেছনে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবদান অনস্বীকার্য। বিভাগ থেকে ফান্ড প্রদান এবং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। “পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ফান্ড প্রদান করা ও অনুপ্রাণিত করার জন্য সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞ,” বলেছেন নুসরাত।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. সালাহউদ্দিনের মন্তব্য এই বিভাগের দূরদর্শী চিন্তাভাবনার প্রমাণ। তিনি বলেছেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তাদের এই অর্জন অন্য শিক্ষার্থীদেরও অনুপ্রাণিত করবে। আমরা আগামীতেও এই সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে চাই।”
৫১তম ব্যাচের উজ্জ্বল নক্ষত্র
নুসরাত জাহান লোপা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। এই ব্যাচটি ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। নুসরাতের এই অর্জন পুরো ব্যাচের জন্য গর্বের বিষয়।
তার কথায়, “আমাদের সকলের অর্জন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক অসাধারণ সাফল্য। সকলের অবদানে আমাদের এই অর্জন।” এই বক্তব্যে তার নম্রতা ও সামগ্রিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষায় নতুন দিগন্ত
আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষায় এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো বিশেষায়িত বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় সফল হওয়া সহজ নয়। কিন্তু নুসরাত ও তার সহপাঠীদের এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, যথাযথ দিকনির্দেশনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরাও বিশ্বমানের অর্জন করতে পারেন।
এই সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়। এটি দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার মান ও সম্ভাবনার একটি উজ্জ্বল সূচক। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের জন্যও এটি অনুপ্রেরণাদায়ক।
আগামীর স্বপ্ন
নুসরাতের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে তার জন্য নতুন সুযোগের দরজা খুলে দেবে। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাওয়া মানে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও এটি একটি মাইলফলক। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়টির সুনাম আরও উজ্জ্বল করেছে।
তারার আলোয় আলোকিত ভবিষ্যৎ
নুসরাত জাহান লোপার এই গল্প শুধু একটি পদক জেতার গল্প নয়। এটি স্বপ্ন দেখা, কঠোর পরিশ্রম করা এবং হাল না ছাড়ার জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রথম বছর ব্রোঞ্জ পেয়ে সন্তুষ্ট না থেকে পরের বছর গোল্ড মেডেল জেতার এই গল্পটি আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা।
রাতের আকাশে তাকিয়ে যখন আমরা তারাদের দেখি, তখন হয়তো ভাবি এগুলো কত দূরে। কিন্তু নুসরাতের মতো তরুণরা প্রমাণ করে দিচ্ছেন যে, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হলে সেই দূরের তারাগুলোও হাতের মুঠোয় চলে আসে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। নুসরাত জাহান লোপা এবং তার মতো মেধাবী তরুণরাই সেই ভবিষ্যতের কারিগর। আজ যারা তারার আলোয় স্বপ্ন দেখছেন, কাল তারাই হবেন দেশের গর্ব।