বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫
HomeBusinessEntrepreneurshipগার্মেন্টস শ্রমিক থেকে অনলাইন উদ্যোক্তা: লিমার অনুপ্রেরণার গল্প

গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে অনলাইন উদ্যোক্তা: লিমার অনুপ্রেরণার গল্প

একটা ছোট ছাপার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একজন নারী। তার হাতে তিন রঙা জামার ডিজাইন প্রিন্টআউট, চোখে স্বপ্ন—নিজের ব্র্যান্ড বানাবেন।

এই নারী লিমা। একসময় যিনি গার্মেন্টসে শ্রমিক ছিলেন, আজ তিনি “Lima’s Wear” নামের অনলাইন ক্লোদিং ব্র্যান্ডের মালিক।

কিন্তু লিমার যাত্রাটা খুব মসৃণ ছিল না। বরং ছিল ঘামের, চোখের পানি আর প্রতিদিনকার লড়াইয়ের গল্প।

এই লেখায় আমরা জানবো কীভাবে এক গার্মেন্টস কর্মী ধৈর্য, সাহস ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে নিজের জীবন বদলে ফেলেছেন—এবং তার গল্প হয়তো বদলে দেবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিও।

“আমার জীবনের প্রথম বেতন ২,৬০০ টাকা”

লিমা বাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলায়। বাবা দিনমজুর, মা গৃহিণী। স্কুলে খুব ভালো ছাত্রী হলেও দারিদ্র্যের কারণে এসএসসি’র পরেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।

চাকরির খোঁজে আসে ঢাকায়, গার্মেন্টসে যোগ দেয় ১৭ বছর বয়সে।

“একটাই স্বপ্ন ছিল—বাসায় টাকা পাঠাবো। ছোট ভাইটা যেন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।”

প্রথম ২ বছর সেলাই অপারেটর হিসেবে কাজ করে। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা। যেদিন ওভারটাইম থাকে, সেদিন ফেরে রাত ১০টায়।

গার্মেন্টস ফ্লোরে বসেই ব্যবসার আইডিয়া

হলিডে’তে একটা জামা বানিয়ে নিজেই পরেছিল লিমা। সহকর্মীরা দেখে বলল, “তুই বানাইছস? দে দেখি, আমিও বানাবো।”

সেখান থেকেই মাথায় আসলো: “আমি যদি নিজে ডিজাইন করি, নিজের একটা কিছু করি, কেমন হয়?”

শুরু করলো ফেসবুক পেজ। নাম দিলো—“Lima’s Wear”। শুরুতে নিজের বোনের ফোন দিয়েই ছবি তুলে পোস্ট করত।

প্রথম অর্ডার এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে—দুইটা সালোয়ার কামিজ। কুরিয়ার দিতে গিয়ে হাত কাঁপছিল, কারণ কখনো এমন কাজ করেনি।

চ্যালেঞ্জ, সমালোচনা আর যুদ্ধ—নিজের সঙ্গে

একটা মেয়ে, গার্মেন্টসে কাজ করে, ব্যবসা করতে চায়—এই বিষয়টা অনেকের কাছেই ‘হাস্যকর’ লেগেছিল।

বন্ধু বলল—“তোকে দিয়ে হবে না।”

বোন বলল—“দেখবি কাস্টমার ধোঁকা দিবে।”

আরো অনেকে বলেছে—“মেয়েরা ঘরের বাইরে গেলে পরিবার নষ্ট হয়।”

তবে লিমার জবাব ছিল একটাই—

“যদি নিজের ওপর ভরসা থাকে, তাহলে ধাপে ধাপে হবে। আমার জ্ঞান কম, কিন্তু ইচ্ছা অনেক।”

ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অর্ডার, বিশ্বাসও

লিমা একসময় ৫টা অর্ডার একসঙ্গে পায়। তখন বুঝতে পারে, একার পক্ষে সম্ভব নয়। গার্মেন্টসের এক বান্ধবীকে বলে—

“চল একসঙ্গে কাজ করি। অল্প অল্প করে সেলাই করবো, কাস্টমার দেবে আমি প্রোমো করবো।”

দুজন মিলে শুরু করে।

প্রথম ৬ মাসেই প্রায় ৫০,০০০ টাকার অর্ডার হয়।

“তখনই ঠিক করি—এই কাজটাই আমার ভবিষ্যৎ হবে।”

চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত: ভয় আর সাহসের মাঝামাঝি

দেড় বছরের মাথায় লিমা সিদ্ধান্ত নেয়—গার্মেন্টসের চাকরি ছাড়বে।

“ভয় লাগছিল। বোন বলে—এই কাজ রেখে দিছস? পাগল হইছস?”

কিন্তু লিমা জানত, যদি নিজেকে পুরোপুরি সময় না দেয়, তাহলে Lima’s Wear কখনো বড় হবে না।

চাকরি ছাড়ার পর পুরো মনোযোগ দেয় ব্যবসায়। ডিজাইন, ফ্যাব্রিক বাছাই, কাস্টমার মেসেজ, প্যাকেজিং—সবই নিজে করত।

আজ Lima’s Wear কী করে?

  •  মাসে গড়ে ১,৫০,০০০ টাকার বিক্রি
  •  ৪ জন কর্মী
  •  ১টা ছোট অফিস কাম ওয়ার্কশপ
  • বাংলাদেশের বাইরেও ৮টা অর্ডার গেছে (UK, UAE)

লিমা এখন নিজের পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী।

ছোট ভাই এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মা-বাবা এখন গ্রামের বাড়িতে নতুন টিনের ঘরে থাকেন।

এই গল্পটা শুধু লিমার না—হাজারো নারীর গল্প

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ নারী গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যেতে পারেন না।

কারণ কী?

  • প্রশিক্ষণের অভাব
  •  আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি
  • সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি (“নারী মানেই ঘর”)
  • উদ্যোক্তা হওয়ার পথ জানা নেই

তবে ভালো খবর হলো—অনেকেই এখন উদ্যোক্তা হচ্ছেন, অনলাইন স্টোর খুলছেন, নিজের কাজ চালাচ্ছেন।

লিমার ৫টি শেখা—যা আপনার পথ বদলাতে পারে

  • ছোট করে শুরু করুন, বড় করে ভাবুন

    → এক জামা দিয়েও শুরু করা যায়।

  • ফোন থাকলেই ব্যবসা সম্ভব

    → Lima’s Wear শুরু হয়েছিল শুধু ফেসবুক পেজ দিয়ে।

  • ভয় থাকবে, তবু হাঁটুন

    → চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় ঝুঁকি নিয়েছে বলেই আজ সে সফল।

  • নিজেকে আপডেট করুন

    → ফ্রি কোর্স, ইউটিউব, অন্য ব্যবসার পেজ দেখুন—শেখা বন্ধ করবেন না।

  • পরিবারকে বোঝান, বিরোধ নয়

    → সময় নিয়ে কথা বলুন, কী করতে চান বুঝিয়ে বললে পরিবারও সাপোর্ট দেয়।

“আপনি গার্মেন্টসে কাজ করেন বলে আপনি কম নন”

আজ হয়তো আপনি লিমার জায়গায় আছেন। হয়তো আপনারও একটা ছোট আইডিয়া আছে। হয়তো এখনই কেউ বিশ্বাস করছে না।

কিন্তু মনে রাখুন—সফলতা কখনো এক রাতের নয়, কিন্তু শুরুটা আজই হতে পারে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular