আনিকার বয়স ২২। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। প্রতিদিন ক্লাসে যেতেই ভুলে যায়, বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোর ওপর তার মনই বসে না। পরীক্ষার আগের রাতে বই খুলে বসে, কিন্তু মাথায় কিছু ঢোকে না। কেউ বলেন, “তুমি আলসে”, কেউ বলেন “মনোযোগের অভাব তোমার মধ্যে সবসময়”। আনিকা নিজেই ভাবে, হয়তো তার মধ্যেই সমস্যা।
তবে যদি বলি—এসব আচরণ আসলে ADHD-এর লক্ষণ?
ADHD বা Attention-Deficit/Hyperactivity Disorder—বাংলাদেশে এটা এখনো অনেকাংশেই ভুল বুঝে নেয়া হয়। “ADHD মানেই দুষ্টু বাচ্চা” অথবা “এই রোগ শুধু শিশুদের হয়”—এমন ভুল ধারণা আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত।
চলুন, আজকের আলোচনায় আমরা জানি ADHD নিয়ে ৩টি প্রচলিত ভুল ধারণা (Myths) এবং তার বাস্তব সত্য (Facts)।
Myth ১: ADHD কেবল শিশুদেরই হয়
Fact: ADHD বড়দের মধ্যেও হয়, এবং অনেক সময় তা শনাক্তই হয় না
ADHD মানেই শিশুদের রোগ—এ ধারণা একেবারেই ভুল। শিশুদের মধ্যে এটি শুরু হলেও অনেকেই কৈশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় গিয়েও এই সমস্যার ভেতরে থাকেন।
অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মনোযোগের সমস্যা, সময় ব্যবস্থাপনায় অক্ষমতা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা উত্তেজনা ADHD-এরই লক্ষণ হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা না থাকায়, অনেকেই এটিকে “ব্যর্থতা” বা “অলসতা” হিসেবে ধরে নেয়।
Myth ২: ADHD মানে তুমি শুধু দুষ্টু আর অশান্ত
Fact: ADHD মানে মানসিকভাবে অতিমাত্রায় সক্রিয় বা মনোযোগের অভাব, তবে সবসময় নয়
ADHD রোগীরা সবাই দুষ্টু বা হাইপার এমন না। ADHD-এর দুই ধরনের প্রধান ধরণ আছে:
- Inattentive Type: যারা খুবই চুপচাপ কিন্তু মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না
- Hyperactive-Impulsive Type: যারা বেশি চঞ্চল, তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেয়
কেউ হয়তো বাইরের দিক থেকে “ভদ্র” বা “নরম” মনে হয়, কিন্তু ভেতরে ADHD-এর কারণে সে প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে। তাই ADHD বোঝা শুধু বাহ্যিক আচরণের ওপর নির্ভর করে নয়।
Myth ৩: ADHD থাকলে কিছুই করা যায় না
Fact: সঠিক চিকিৎসা, থেরাপি ও সহানুভূতিশীল পরিবেশ পেলে ADHD রোগীরা জীবনেও দারুণ সফল হতে পারেন
বিশ্বে অনেক বিখ্যাত মানুষ যেমন—Michael Phelps (অলিম্পিক সাঁতারু), Simone Biles (জিমন্যাস্ট), Will Smith (অভিনেতা)—তাদের ADHD ছিল। কিন্তু তারা সঠিক সময়ের থেরাপি, মেডিটেশন, রুটিন এবং পরিবার-সমাজের সহানুভূতিশীল সমর্থন পেয়েছেন।
বাংলাদেশে আমাদের স্কুল, পরিবার বা অফিসে ADHD-সহ অনেক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় না বলেই, সমস্যাগুলো লুকিয়ে থাকে, বড় হয়ে যায়। সময়মতো যদি মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদার বা কাউন্সেলর পাওয়া যেত, তাহলে অনেক তরুণ-তরুণী নিজেদের ‘ভুল’ নয়, ‘ভিন্ন’ভাবে চিন্তা করার শক্তিকে কাজে লাগাতে পারতো।
ADHD কীভাবে চিহ্নিত করবেন?
প্রাপ্তবয়স্কদের ADHD শনাক্তে কিছু লক্ষণ:
- কাজ শুরু করতে সমস্যা হওয়া বা মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া
- অল্প সময়েই একঘেয়ে অনুভব করা
- সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারা
- নিয়মিত জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলা
- অতিরিক্ত চিন্তা করা বা decision paralysis
- Impulsive behavior – হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া, বলা
এসব লক্ষণ থাকলে ভুলভাবে নিজেকে দোষারোপ না করে, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
ADHD নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা কী করতে পারি?
১. অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতনতা:
ADHD থাকলে বাচ্চাকে “দুষ্টু” না বলে বুঝতে হবে তার আচরণ আসলে মস্তিষ্কের একধরনের wiring-এর অংশ।
২. পরীক্ষা বা পড়াশোনায় বিকল্প পদ্ধতি:
সব বাচ্চা একভাবে শেখে না। কেউ হয়তো অডিওতে ভালো বোঝে, কেউ চিত্র দেখে। ADHD বাচ্চাদের জন্য মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতি বেশি কার্যকর।
৩. কমিউনিটি লেভেলে মানসিক স্বাস্থ্য ক্যাম্প:
জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে ADHD ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা নিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করা উচিত।
৪. কর্মস্থলে সহানুভূতির পরিবেশ:
কর্মীদের মধ্যে ADHD থাকলেও তারা অনেক সময় অন্যদের তুলনায় বেশি ক্রিয়েটিভ, প্রোডাক্টিভ হতে পারেন—যদি সঠিক রোল ও রুটিন পান।
আমাদের সমাজকে আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে
“ADHD মানেই অলসতা”, “বাচ্চা ভালো না”—এইসব ভুল ধারণার বদলে দরকার আরও সহানুভূতিশীল ও বুঝদার সমাজ গড়ে তোলা।
মানসিক স্বাস্থ্য মানে শুধু “পাগল” না, ADHD-এর মতো নিউরোডাইভারসিটি বোঝাও এর অংশ। এই বিষয়গুলো নিয়ে পরিবারে, স্কুলে, অফিসে খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার।
ADHD একদিনে শেষ হয়ে যায় না। এটা কোনো ‘চিকিৎসা করে সেরে ওঠা’র রোগ নয়—এটা একটি ভিন্নভাবে কাজ করা মস্তিষ্কের রূপ, যার জন্য দরকার বোঝাপড়া, সহানুভূতি আর দীর্ঘমেয়াদী সমর্থন।
আমাদের চারপাশে কেউ হয়তো খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, সময়মতো কাজ জমা দিতে পারে না, বারবার ভুল করে ফেলে—তাকে “অগোছালো” বা “অযোগ্য” না ভেবে, ভাবুন, হয়তো তার মনে এমন কিছু চলছে, যা আপনি বাইরে থেকে দেখছেন না।
তাই, আমাদের দায়িত্ব—বলার আগে ভাবা, রাগ করার আগে বোঝার চেষ্টা করা।
নিজের ক্ষেত্রেও তাই—যদি নিজের মাঝে এইসব লক্ষণ অনুভব করেন, ভয় পাবেন না। আপনি একা নন। পেশাদার সাহায্য নেওয়া দুর্বলতা নয়—বরং সচেতনতার শক্তি।
মনে রাখুন:
- ADHD আপনাকে সংজ্ঞায়িত করে না
- আপনি কোনো “ভুল সংস্করণ” না—আপনি একজন ভিন্নধারার মানুষ
- সহানুভূতি, সময় ও সঠিক সাপোর্টে, আপনি ফুলের মতোই ফুঁটে উঠতে পারেন