“অবসরে গিয়ে যেন কারও উপর নির্ভর করতে না হয়—এই কথাটা বাবা সবসময় বলতেন। কিন্তু নিজে সে প্রস্তুতি নিতে পারেননি। তাই আমরা সন্তানরা যতটা পারি, চেষ্টা করি তাকে স্বস্তি দিতে।”
এই গল্পটা বাংলাদেশে হাজারো পরিবারের। আমরা অনেকেই কাজের ব্যস্ততায় ‘অবসর’ ভাবনা এড়িয়ে যাই। অথচ জীবনটা যখন কর্মব্যস্ততা থেকে ছুটি নেয়, তখন সবচেয়ে দরকার হয় — অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
আজকের এই লেখায় আলোচনা করব, কীভাবে এখন থেকেই অবসর জীবনকে নিরাপদ করতে পারবেন একটি সুপরিকল্পিত আর্থিক কাঠামোর মাধ্যমে।
অবসর জীবন—চিন্তা না শান্তির সময়?
অবসর মানে শুধু কাজ না করা নয়, বরং সময় পাওয়া নিজের জন্য, পরিবার-বন্ধুর জন্য, কিংবা শখের কোনো কিছু করার জন্য।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—যদি অর্থের চিন্তা থেকেই যায়, তাহলে সেই অবসর কি আর আরামদায়ক হয়?
বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ অবসরের সময় নির্ভর করেন—
- পেনশন বা গ্র্যাচুইটির উপর
- সন্তানের সহযোগিতার উপর
- বা জমি-বাড়ি থেকে আসা সামান্য আয়ে
কিন্তু এই সবই যদি না হয়? কিংবা যথেষ্ট না হয়?
তাই প্রয়োজন ব্যক্তিগত অবসর পরিকল্পনা, যেটা আপনি নিজে গড়ে তুলবেন, নিজেই নিয়ন্ত্রণ করবেন।
কেন অবসর পরিকল্পনা এখনই জরুরি?
১. জীবন প্রত্যাশা বেড়েছে — আগে যেখানে মানুষ ৬৫-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচতেন, এখন ৮০ বা তারও বেশি বছর পর্যন্ত সুস্থ থাকেন।
২. চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে — বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওষুধ, চেকআপ, চিকিৎসার খরচও বাড়ে।
৩. জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে — মুদ্রাস্ফীতি, বাজারদর, সেবার খরচ—সবই বাড়ছে নিয়মিত।
৪. সন্তানদের উপর নির্ভরতা কমছে — নতুন প্রজন্ম অনেক সময় আলাদা থাকে বা নিজের চাপে পড়ে।
তাই, এখন থেকেই পরিকল্পনা করলে ভবিষ্যৎ হবে স্বস্তির।
অবসর পরিকল্পনার ৫টি ধাপ
১. লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
প্রথমেই ভাবুন—অবসরের পর আপনি কেমন জীবন চান?
- মাসে কত টাকা দরকার হবে?
- আপনি ভ্রমণ করতে চান? নতুন শখ গড়তে চান?
- চিকিৎসা বা হোম কেয়ারের খরচ কেমন হতে পারে?ধরুন, আপনি অবসরের পর মাসে ৩০,০০০ টাকা ব্যয় করতে চান এবং কমপক্ষে ২০ বছর সুস্থভাবে বাঁচবেন। তাহলে আপনার মোট প্রয়োজন:
৩০,০০০ × ১২ × ২০ = ৭২ লাখ টাকা (কমবেশি ধরে)
২. মাসিক সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ুন
আমাদের দেশে অনেকেই অবসরের কথা ভাবলেও সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়েন না।
- আয় থেকে অন্তত ২০% অবসর সঞ্চয়ে রাখুন
- অফিসের Provident Fund বা GPF ছাড়াও আলাদা সঞ্চয় করুন
- বাড়তি আয় বা বোনাস থেকে আলাদা একটা ফান্ড গড়ুন
যেন: যদি আপনি ৩০ বছর বয়সে মাসে ৫,০০০ টাকা জমাতে শুরু করেন এবং বছরে গড়ে ১০% রিটার্ন পান, তাহলে ৫৫ বছরে তা দাঁড়াবে প্রায় ৬০ লাখ টাকারবেশি!
৩. স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট করুন
টাকা শুধু জমিয়ে রাখলে চলবে না, তা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে আপনি নিচের জায়গাগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারেন:
- মিউচুয়াল ফান্ড: নিরাপদ ও তুলনামূলক ভালো রিটার্ন দেয়
- বন্ড ও সঞ্চয়পত্র: সরকার অনুমোদিত, নির্ভরযোগ্য
- স্টক মার্কেট: ঝুঁকি আছে, কিন্তু লং টার্মে ভালো রিটার্ন দিতে পারে
- রিয়েল এস্টেট: ভাড়া বা বিক্রির মাধ্যমে আয়
ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ (Diversification) করুন।
৪. স্বাস্থ্য খরচের জন্য প্রস্তুত থাকুন
অবসরের বয়সে সবচেয়ে বড় খরচ হয় স্বাস্থ্যব্যয়।
- একটি ভালো হেলথ ইনস্যুরেন্স নিন
- বার্ষিক হেলথ চেকআপ অভ্যাসে আনুন
- ফার্মেসির খরচ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি ফান্ড গড়ে তুলুন
৫. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে রাখুন
- Nominee ঠিক করুন সঞ্চয় ও বিনিয়োগের জন্য
- আপনার পেনশন, গ্র্যাচুইটি, ইন্স্যুরেন্স—সব ডকুমেন্ট ঠিকমতো সাজিয়ে রাখুন
- সন্তানদের বুঝিয়ে দিন কোথায় কী আছে
এটি শুধু আপনার জন্য নয়, ভবিষ্যতে পরিবারের জন্যও অনেক সহায়ক হবে।
বাস্তব গল্প: অবসর মানেই নির্ভরশীলতা নয়
নারায়ণগঞ্জের রেজওয়ানা খাতুন ৩০ বছর চাকরির পর অবসরে গিয়েছেন।
“আমি অফিসের Provident Fund-এর বাইরেও নিজে ছোট ছোট করে সঞ্চয় করতাম। একটা ভাড়া বাসা কিনেছি, কিছু মিউচুয়াল ফান্ড রেখেছি। এখন মাসে ৩ জায়গা থেকে আয় আসে—কাউকে বলতে হয় না।”
এই উদাহরণই বলে দেয়, আপনি চাইলে অবসর জীবন নির্ভরশীল নয়, আত্মনির্ভর হতে পারে।
অবসর জীবন যদি হয় স্বাধীন, নিরাপদ ও শান্তিময়—তবে এখন থেকেই হতে হবে সচেতন।
- মাসিক সঞ্চয়
- স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট
- স্বাস্থ্য সচেতনতা
- আর্থিক পরিকল্পনার নিয়মিত পর্যালোচনা
অবসর জীবন মানে নতুন করে বাঁচা—শুধু নির্ভরতাই নয়, নিজেকে সময় দেওয়ার স্বর্ণালী সুযোগ।