গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের উত্থান একটি স্পষ্ট সত্য হয়ে উঠেছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্ভাবনাময় অংশ নিঃসন্দেহে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম। তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি, সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা—সব মিলিয়ে দেশের স্টার্টআপ খাত একটি মোড় ঘোরানো পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি কেমন? আসুন বিশ্লেষণ করি।
বর্তমান চিত্র: যাত্রা কতদূর?
বর্তমানে বাংলাদেশে ২,৫০০টিরও বেশি স্টার্টআপ সক্রিয় রয়েছে। এদের মাধ্যমে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিকাশ, পাঠাও, শপআপ, টেন মিনিট স্কুল—এগুলো এখন শুধু নাম নয়, উদ্ভাবনের প্রতীক। বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচটি ইউনিকর্ন (১ বিলিয়ন ডলারের স্টার্টআপ) তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। এছাড়া ICT Division-এর “Startup Bangladesh” উদ্যোগ স্টার্টআপদের জন্য প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়নের পরিবেশ তৈরি করছে।
বড় চ্যালেঞ্জগুলো কোথায়?
১. তহবিল ও বিনিয়োগের সংকট
যথাযথ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডের অভাব বাংলাদেশের স্টার্টআপদের সবচেয়ে বড় বাধা। এখনো বিদেশি বিনিয়োগ নির্ভরতা বেশি। তাছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্যোক্তারা অধিকাংশ সময় বন্ধু-পরিবার বা নিজস্ব সঞ্চয় নির্ভর করেই যাত্রা শুরু করেন।
২. প্রশাসনিক জটিলতা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য
বিনিয়োগ লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স ফাইলিং—এসবের প্রক্রিয়া এখনো জটিল। অনেক উদ্যোক্তা সরকারি প্রক্রিয়ায় ভয় পান বা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
৩. দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি
AI, IoT, ব্লকচেইনের মতো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর উপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এখনো সীমিত। ফলে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর স্টার্টআপ তৈরি কঠিন হয়ে পড়ে।
৪. মুনাফার চেয়ে গ্রোথ ট্র্যাকশনে ফোকাস
অনেক স্টার্টআপ টেকসই মডেলের চেয়ে দ্রুত গ্রোথে মনোযোগ দেয়। এতে আস্থা হারান বিনিয়োগকারীরা। স্থায়িত্বের বদলে অনেকেই দেখা যায় “valuation”-এ মুগ্ধ।
সম্ভাবনার দিগন্ত: কোথায় আমাদের শক্তি?
১. তরুণ জনগোষ্ঠী: বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ, প্রযুক্তি সচেতন ও উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী।
২. সরকারি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা: Startup Bangladesh, Idea Project, UNDP, ADB, এবং বিভিন্ন ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগ করছে।
৩. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বাজার: শপআপ ও সৌদির সারির একীভূত হওয়া এবং ১১ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশি স্টার্টআপ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে প্রস্তুত।
কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়?
১. ফান্ড অব ফান্ডস গঠন
সরকারি বা বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে ফান্ড তৈরি করে দেশীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটালগুলোর পুঁজি সহজতর করা প্রয়োজন। এতে স্থানীয় স্টার্টআপরা আরও বেশি সুযোগ পাবে।
২. নীতিমালার সরলীকরণ
স্টার্টআপ-ফ্রেন্ডলি নীতিমালা, করছাড়, এবং সহজ লাইসেন্স প্রক্রিয়া হলে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন।
৩. দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি
বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে AI, ডেটা সায়েন্স, প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট, ফিনটেকের উপর বিশেষ কোর্স চালু করা প্রয়োজন।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ইনকিউবেটর, এক্সেলারেটর ও মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম জোরদার করতে হবে।
৫. উদ্ভাবনকে উৎসাহ
রিসার্চ ও প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শুধু অনুকরণ নয়, উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এখন আর একটি সম্ভাবনা নয়, এটি একটি বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতা টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন, নীতিগত সংস্কার, দক্ষ মানবসম্পদ এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে এখনই সময়। আমরা যদি এখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে আগামী দশকে বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার সিলিকন ভ্যালি।