শীতের সকাল। বাইরে ঠান্ডা হাওয়া, কুয়াশা ঢাকা আকাশ, আর লেপের ভেতর একটা স্বর্গীয় আরাম। অ্যালার্ম বাজছে, কিন্তু লেপ থেকে বের হওয়ার কথা ভাবতেই শরীর যেন প্রতিবাদ করে ওঠে। “আর পাঁচ মিনিট… শুধু পাঁচ মিনিট।” কিন্তু সেই পাঁচ মিনিট হয়ে যায় এক ঘণ্টা।
ব্যায়ামের কথা? সেটা তো আরও দূরের বিষয়! জিম যাওয়া বা মর্নিং ওয়াকের প্ল্যান থাকলেও শীতকালে সেটা বাস্তবায়ন করা যেন অসম্ভব মিশন।
এই চেনা পরিস্থিতি প্রায় সবারই। কিন্তু প্রশ্ন হলো—শীতকালে কেন এত অলসতা লাগে? কেন ঘুম থেকে উঠতে, ব্যায়াম করতে এত কষ্ট হয়? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই অলসতা কাটিয়ে কীভাবে শীতেও অ্যাক্টিভ থাকা যায়?
আজকে আমরা জানবো শীতকালীন অলসতার সায়েন্টিফিক কারণ এবং পাঁচটি প্র্যাক্টিকাল স্মার্ট উপায় যা আপনাকে এই শীতে এনার্জেটিক এবং প্রোডাক্টিভ রাখবে।
কেন শীতকালে ঘুম থেকে ওঠা এত কঠিন?
১. মেলাটোনিন হরমোনের খেলা
শীতকালে দিন ছোট হয়ে যায়, অন্ধকার বেশি সময় থাকে। আমাদের শরীর মেলাটোনিন নামক একটি হরমোন তৈরি করে যা “স্লিপ হরমোন” নামে পরিচিত। অন্ধকারে এই হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, ফলে ঘুম ঘুম ভাব বেশি লাগে এবং সকালে উঠতে কষ্ট হয়।
গ্রীষ্মকালে সূর্য তাড়াতাড়ি ওঠে, ফলে আলো পেয়ে শরীর জেগে ওঠার সংকেত পায়। কিন্তু শীতে সূর্য দেরিতে ওঠে এবং কুয়াশার কারণে আলো কম আসে, তাই শরীর বুঝতে পারে না যে জাগার সময় হয়েছে।
২. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
ঠান্ডা পরিবেশে শরীর তাপ সংরক্ষণ করতে চায়। লেপের ভেতরের উষ্ণতা এবং বাইরের ঠান্ডা তাপমাত্রার পার্থক্য এত বেশি যে শরীর স্বাভাবিকভাবেই বাইরে যেতে চায় না। এটা একধরনের সার্ভাইভাল মেকানিজম—শরীর এনার্জি সেভ করতে চায়।
৩. সেরোটোনিন লেভেল কমে যাওয়া
সূর্যের আলোর অভাবে শরীরে সেরোটোনিন (হ্যাপি হরমোন) উৎপাদন কমে যায়। এর ফলে মুড ডাউন থাকে, এনার্জি কম লাগে এবং কিছু করতে ইচ্ছা করে না। অনেকে শীতকালে “সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার” (SAD) এ ভোগেন, যেখানে বিষণ্ণতা এবং অলসতা প্রধান লক্ষণ।
৪. শারীরিক এনার্জি লেভেল
শীতকালে শরীর বেশি ক্যালোরি বার্ন করে শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে। তাই সামগ্রিক এনার্জি লেভেল কিছুটা কম থাকে এবং অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে শরীর অনিচ্ছুক হয়।
শীতে ব্যায়াম করা কঠিন হয়ে যায় কেন?
১. পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া
ঠান্ডা আবহাওয়ায় মাসল টিস্যু এবং জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে যায়। ওয়ার্ম আপ না করে সরাসরি ব্যায়াম শুরু করলে ইনজুরির ঝুঁকি বাড়ে এবং শরীর কম ফ্লেক্সিবল অনুভব করে।
২. মোটিভেশনের অভাব
উষ্ণ লেপের কম্ফোর্ট জোন ছেড়ে ঠান্ডা পরিবেশে ব্যায়াম করার মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন। ঘরের বাইরে যাওয়ার চিন্তাই মনকে ভারী করে দেয়।
৩. দিনের আলো কম থাকা
অন্ধকারে ব্যায়াম করা অনিরাপদ এবং আগ্রহহীন মনে হয়। সকালে বা সন্ধ্যায় অন্ধকার থাকলে আউটডোর অ্যাক্টিভিটি করতে অনীহা তৈরি হয়।
অলসতা কাটানোর ৫টি স্মার্ট উপায়
১. “গ্র্যাজুয়াল ওয়েক-আপ” মেথড: ধীরে ধীরে শরীরকে প্রস্তুত করুন
সরাসরি লেপ থেকে লাফ দিয়ে উঠার চেষ্টা না করে, ধাপে ধাপে শরীরকে জাগান।
কীভাবে করবেন:
অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথে চোখ খুলুন প্রথম অ্যালার্মেই স্নুজ বাটন চাপা এড়িয়ে চলুন। চোখ খুলে সিলিং এর দিকে তাকান, গভীর শ্বাস নিন তিনবার।
লেপের ভেতরেই হালকা স্ট্রেচিং লেপের ভেতরে থেকেই হাত-পা টানান, ঘাড় ঘুরান। ২-৩ মিনিট এভাবে শরীরকে ওয়েক আপ করুন।
আস্তে আস্তে উঠুন লেপ একবারে সরিয়ে না ফেলে, প্রথমে বসুন, তারপর দাঁড়ান। শরীরকে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে অভ্যস্ত হতে সময় দিন।
রাতে ঘুমানোর আগে রুম হিটার বা এসি টাইমার সেট করে দিন যাতে সকালে উঠার ৩০ মিনিট আগে রুম কিছুটা উষ্ণ হয়ে যায়। এতে উঠতে অনেক সহজ হবে।
২. “সানলাইট এক্সপোজার”: প্রাকৃতিক আলোর শক্তি কাজে লাগান
সূর্যের আলো আপনার শরীরের জৈবিক ঘড়ি রিসেট করে এবং এনার্জি বুস্ট করে।
প্র্যাক্টিকাল প্ল্যান:
সকাল ৮-৯টার মধ্যে: উঠেই জানালার পর্দা খুলে দিন। যত দ্রুত সম্ভব সূর্যের আলো চোখে পড়ুক। ১৫-২০ মিনিট রোদে দাঁড়ান বা বসুন। এটা মেলাটোনিন প্রোডাকশন বন্ধ করে এবং সেরোটোনিন বাড়ায়।
দুপুরে: লাঞ্চ ব্রেকে ছাদে বা বারান্দায় কিছুক্ষণ সময় কাটান। ভিটামিন ডি পাবেন এবং মুড ভালো হবে।
ঘরের ভেতরে কাজ করলেও: জানালার কাছে বসে কাজ করার চেষ্টা করুন। প্রাকৃতিক আলো প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায়।
যদি প্রাকৃতিক আলো পর্যাপ্ত না পান, “লাইট থেরাপি ল্যাম্প” ব্যবহার করতে পারেন। এটা বিশেষভাবে কার্যকর সিজনাল ডিপ্রেশনের জন্য।
৩. “মর্নিং মোটিভেশন ট্রিগার”: ঘুম থেকে ওঠার জন্য শক্তিশালী কারণ তৈরি করুন
অ্যালার্ম বাজলে যদি শুধু “উঠতে হবে” চিন্তা মাথায় আসে, তাহলে স্নুজ করার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু যদি উঠার একটা এক্সাইটিং কারণ থাকে, তাহলে উঠতে সহজ হয়।
কীভাবে করবেন:
সকালের জন্য কিছু বিশেষ পরিকল্পনা রাখুন:
- প্রিয় নাশতা (চকলেট প্যানকেক, ফ্রেশ জুস, বা কোনো স্পেশাল খাবার)
- সকালে প্রিয় একটা সিরিজ বা পডকাস্ট শোনা
- বন্ধুর সাথে মর্নিং ওয়াকের প্ল্যান (একসাথে প্ল্যান থাকলে একাউন্টেবিলিটি বাড়ে)
- সকালে কিছু মজার কাজ (রিডিং, জার্নালিং, বা হবি)
একটা চ্যালেঞ্জ সেট করুন: “এই মাসে ২০ দিন সকাল ৬টায় উঠবো”—এরকম একটা চ্যালেঞ্জ নিন। ক্যালেন্ডারে টিক দিন প্রতিদিন। এতে মোটিভেশন থাকে।
রিওয়ার্ড সিস্টেম: সপ্তাহে ৫ দিন সময়মতো উঠতে পারলে নিজেকে একটা ছোট রিওয়ার্ড দিন (প্রিয় রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, নতুন বই কেনা)।
৪. “ইনডোর ওয়ার্ম-আপ ওয়ার্কআউট”: ঘরেই শুরু করুন ব্যায়াম
শীতে বাইরে যাওয়া কঠিন মনে হলে, ঘরের ভেতরেই ব্যায়াম শুরু করুন।
১৫ মিনিটের ইনডোর ওয়ার্ম-আপ রুটিন:
ওয়ার্ম-আপ (৫ মিনিট):
- স্পট জগিং: ২ মিনিট
- আর্ম সার্কেল এবং লেগ সুইং: ২ মিনিট
- জাম্পিং জ্যাকস: ১ মিনিট
মেইন ওয়ার্কআউট (৮ মিনিট):
- স্কোয়াটস: ১৫ রিপিটিশন
- পুশ-আপস (হাঁটুতে ভর দিয়েও করতে পারেন): ১০ রিপিটিশন
- প্ল্যাঙ্ক: ৩০ সেকেন্ড
- লাঞ্জেস: প্রতি পায়ে ১০টি
- এই সার্কিট ২ বার রিপিট করুন
কুল ডাউন (২ মিনিট):
- স্ট্রেচিং করুন সব বড় মাসল গ্রুপ
কেন এটা কাজ করে: ঘরে ওয়ার্ম-আপ করলে শরীর উষ্ণ হয়ে যায় এবং পরে বাইরে যেতে সহজ মনে হয়। এমনকি বাইরে না গেলেও এই ১৫ মিনিট যথেষ্ট ফিটনেস মেইনটেইন করার জন্য।
৫. “স্লিপ হাইজিন ইমপ্রুভমেন্ট”: রাতের ভালো ঘুমই সকালের ভালো শুরু
সকালে ভালোভাবে উঠতে হলে রাতে ভালো ঘুম জরুরি। শীতকালে আমরা অনেক সময় দেরি পর্যন্ত জেগে থাকি, যা সকালে উঠতে কষ্টকর করে।
স্লিপ হাইজিনের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম:
১. নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান: প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানোর এবং ওঠার অভ্যাস করুন। এতে বডি ক্লক সেট হয়ে যায়।
২. ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে স্ক্রিন টাইম কমান: ফোন, ল্যাপটপ, টিভি থেকে নীল আলো মেলাটোনিন প্রোডাকশন বাধা দেয়। বই পড়ুন বা হালকা সঙ্গীত শুনুন।
৩. বেডরুম ঠান্ডা রাখুন (১৮-২০ ডিগ্রি): অতিরিক্ত গরম রুমে ঘুমের মান খারাপ হয়। হালকা ঠান্ডা পরিবেশ গভীর ঘুমের জন্য আদর্শ।
৪. ক্যাফেইন সন্ধ্যার পর এড়িয়ে চলুন: চা, কফি বিকেল ৪টার পর খাবেন না। এতে রাতে ঘুম আসতে দেরি হয়।
৫. সন্ধ্যায় হালকা ব্যায়াম করুন: রাতে ভারী ব্যায়াম নয়, কিন্তু সন্ধ্যায় হালকা ওয়াক বা যোগব্যায়াম ভালো ঘুমে সাহায্য করে।
পাওয়ার ন্যাপ কন্ট্রোল: দুপুরে ঘুমালে ২০-৩০ মিনিটের বেশি নয়। অতিরিক্ত দুপুরের ঘুম রাতের ঘুমে বিঘ্ন ঘটায়।
ডায়েট এডজাস্টমেন্ট
সকালে প্রোটিন সমৃদ্ধ নাশতা: ডিম, দুধ, বাদাম—এগুলো দীর্ঘসময় এনার্জি দেয় এবং অলসতা কমায়।
ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট: ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন। শীতে সূর্যের আলো কম পাওয়া যায়, তাই এটা জরুরি।
পর্যাপ্ত পানি পান: শীতে পানি পিপাসা কম লাগে, কিন্তু ডিহাইড্রেশন ক্লান্তি বাড়ায়। দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
সোশ্যাল একাউন্টেবিলিটি
বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে একটা “শীতকালীন ফিটনেস চ্যালেঞ্জ” তৈরি করুন। গ্রুপে প্রগতি শেয়ার করুন। একসাথে লক্ষ্য পূরণ করা মজার এবং মোটিভেটিং।
প্রপার ক্লোথিং
ব্যায়ামের জন্য উপযুক্ত শীতের পোশাক কিনুন। লেয়ার্ড ক্লোথিং (একাধিক স্তরের পোশাক) পরুন যাতে শরীর উষ্ণ থাকে কিন্তু অতিরিক্ত গরম না হয়।
শীতকাল মানেই অলসতার সময় নয়। একটু সচেতন প্রচেষ্টা এবং স্মার্ট প্ল্যানিং করলে এই মৌসুমেও আপনি সক্রিয়, সুস্থ এবং প্রোডাক্টিভ থাকতে পারবেন।
মনে রাখবেন:
- শরীরকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করুন
- সূর্যের আলো কাজে লাগান
- সকালে উঠার জন্য মোটিভেশন তৈরি করুন
- ঘরেই ব্যায়াম শুরু করুন
- রাতের ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন
প্রথম কয়েক দিন কঠিন লাগবে, কিন্তু ২-৩ সপ্তাহ পর এটা হ্যাবিটে পরিণত হবে। তখন আর কষ্ট মনে হবে না।

