শনিবার ভোর। ঢাকার এক ব্যস্ত ব্যাংকার আসিফের অফিসের অ্যালার্মটা বন্ধ করে আবার চাদর টেনে নিলেন। সাপ্তাহিক ছুটি বলে কথা—সোম থেকে শুক্র মাঝরাতে ফিরেছেন, ভোরে উঠেই আবার দৌড়। কিন্তু আজ? আজ তিনি একটু বেশি ঘুমোবেন। মজার ব্যাপার হলো, সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ইঙ্গিত—এমন উইকএন্ডে ‘ক্যাচ-আপ স্লিপ’ হৃদয়ের জন্য সত্যিই উপকারী হতে পারে; কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ঘুম কম হলে ছুটির দিনে অতিরিক্ত ঘুম যোগ করলে হার্ট অ্যাটাক–সহ হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ২০% পর্যন্ত কমতে পারে। অবশ্যই এটি কোনো ম্যাজিক নয়—কিন্তু ঘুমের ঘাটতি পূরণ করতে পারলে, হৃদয়ের ওপর চাপ সত্যিই কমে।
চলুন গল্পের ভেতর দিয়ে বুঝে নিই—কেন, কীভাবে, কতটা।
কেন ঘুম হৃদয়ের সঙ্গে এত জড়ানো?
ঘুম কেবল চোখের আরাম নয়—এটা আপনার হৃদপিণ্ড, রক্তচাপ, হরমোন আর প্রদাহ-নিয়ন্ত্রণের ডেইলি মেইনটেন্যান্স। আপনি যখন কম ঘুমান—
- সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (ফাইট-অর-ফ্লাইট) ওভারঅ্যাকটিভ থাকে → হার্টরেট ও রক্তচাপ বাড়ে
- কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন বেশি → হৃদয়ে চাপ
- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ে → ডায়াবেটিসের ঝুঁকি → করোনারি আর্টারিতে প্লাক
- প্রদাহজনিত মার্কার (যেমন CRP) বাড়ে → আর্টারিতে ক্ষতি
ফল? দীর্ঘমেয়াদে রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ওজন—সবই ‘হার্ট-আনফ্রেন্ডলি’ দিকে সরে যায়।
তাহলে উইকএন্ডে বেশি ঘুম কেন কাজ করে?
ব্যস্ত সপ্তাহে যদি আপনার ঘুম ১–২ ঘণ্টা কমে যায়, সেটি জমা ‘স্লিপ ডেব্ট’। গবেষণায় দেখা যায়, ছুটির দিনে ১–২ ঘণ্টা অতিরিক্ত ঘুম সেই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে পারে—
- সিমপ্যাথেটিক টোন কমে → রক্তচাপ স্থিতিশীল
- কর্টিসল-লেভেল নেমে আসে → স্ট্রেস কমে
- ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কিছুটা রিবাউন্ড করে
এই কম্বিনেশনটাই হার্টকে স্বস্তি দেয়। তাই “উইকএন্ড স্লিপ-ইন” আপনার হৃদয়ের জন্য ক্ষুদ্র রিসেট বাটন।
কিন্তু খেয়াল রাখুন: রাতভর জাগা আর পরে দুপুর ১২–১টা পর্যন্ত ঘুম—এটা সমাধান নয়। অতিরিক্ত ‘সোশ্যাল জেটল্যাগ’ (ঘুম-জাগার সময় বেশি পাল্টে ফেলা) আবার নতুন সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশি জীবনের প্রেক্ষাপট: বাস্তব চ্যালেঞ্জ, বাস্তব সমাধান
আমাদের শহুরে জীবনে রাতের ট্রাফিক-স্ট্রেস, লোডশেডিং, গরমে ঘুম ভাঙা, মশা, রুমমেট/ফ্যামিলি রুটিন—সব মিলিয়ে ৭–৮ ঘণ্টা টানা ঘুম পাওয়া কঠিন। তবু কিছু স্মার্ট বদলেই কাজ হবে—
- উইকডে ‘মিনিমাম সেভেন’
সপ্তাহের দিনগুলোতে কমপক্ষে ৭ ঘণ্টা লক্ষ্য রাখুন। ৬–৬.৫ হলে, উইকএন্ডে ১–২ ঘণ্টা ক্যাচ-আপ করুন। - উইকএন্ড বোনাস, কিন্তু সীমার মধ্যে
ছুটির দিনে সাধারণের চেয়ে ৬০–১২০ মিনিট বেশি ঘুম ঠিক আছে। ৩–৪ ঘণ্টা টেনে দিলে রাতে ঘুম আসতে দেরি হবে—চক্র ভেঙে যাবে। - দুপুরের ঘুম ‘পাওয়ার ন্যাপ’
২০–৩০ মিনিটের ন্যাপ বিকেলের আগে—রাত্রির ঘুম নষ্ট হয় না, তবু হার্ট-ফ্রেন্ডলি ফ্রেশ লাগে। ৪টার পর লম্বা ন্যাপ এড়িয়ে চলুন। - ঢাকার গরমে ঘুমের হ্যাক
রুমের তাপমাত্রা ২৪–২৬°C রাখুন, লো-নয়েজ ফ্যান/হোয়াইট-নয়েজ অ্যাপ, মশারির সঙ্গে লাইট অফ—বডি টেম্প নামলে ঘুম গভীর হয়। - স্ক্রিন-কারফিউ
ঘুমের ১ ঘণ্টা আগে নীল আলো বন্ধ। খবর/রিলস/অফিস চ্যাট—সব ‘টুমরো’। চান তো Fajr-রুটিনের সঙ্গে রাতটা শুয়ে দিন—কনসিস্টেন্সি হার্টের বন্ধু।
“আব্বু, আমার হার্ট তো ঠিক আছে!”—তাহলে এত ঝামেলা কেন?
ধরা যাক, তানিয়া (৩২) আইটি কাজ করেন। দিনে বসে কাজ, রাতে শোয়ার সময় ১টা—ভোরে ৭টায় উঠা। সপ্তাহে ২–৩ দিন এই ঘুম ৫–৬ ঘণ্টায় নেমে যায়। তানিয়া বলবেন, “আমি তো ঠিক আছি!”
কিন্তু ভিতরে ভিতরে—
- ব্লাড প্রেসার ধীরে ধীরে ওপরে
- বডি-ওয়েট একটু একটু করে বাড়ছে
- শরীরের প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) চুপচাপ জমছে
এগুলোই একদিন হার্টকে নীরবে আঘাত করে। তাই আজ ঘুমে বিনিয়োগ মানে কাল হার্টে সেভিংস।
কত ঘণ্টা ঘুম সেফ?
- বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কের জন্য ৭–৯ ঘণ্টা/রাত
- ৬ ঘণ্টার নিচে ঘুম নিয়মিত হলে রিস্ক বাড়ে
- আবার ১০ ঘণ্টার বেশি ঘুমও (নিয়মিত) কিছু গবেষণায় উচ্চ ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত—সাধারণত অন্য স্বাস্থ্য সমস্যার সংকেত হতে পারে
কী করবেন? সপ্তাহজুড়ে ৭–৮ ঘণ্টা কনসিস্টেন্ট, না পারলে উইকএন্ডে ১–২ ঘণ্টা ক্যাচ-আপ, এবং দুপুরে ছোট ন্যাপ—এই ‘ত্রিমাত্রা’ই সেফ-সুইট-স্পট।
হার্ট-স্মার্ট স্লিপ—একটি ৭-দিনের সহজ প্ল্যান
সোম–বৃহস্পতি:
- রাত ১১টার মধ্যে বিছানায়
- ১৫ মিনিট বই/দোয়া/শ্বাস-প্রশ্বাস—স্ক্রিন নয়
- ঘুম ১১:১৫–৬:১৫ (≈৭ ঘন্টা)
শুক্র:
- সম্ভব হলে একই রুটিন; সামাজিক ইভেন্ট হলে ১২:১৫–৭:১৫
শনি (ক্যাচ-আপ):
- স্বাভাবিকের চেয়ে +৯০ মিনিট: ১২টা–৮টা
- সকাল রোদে ১০–১৫ মিনিট এক্সপোজার, হালকা হাঁটা—রাতের ঘুম বজায় রাখতে সাহায্য করবে
রবি:
- স্বাভাবিক রুটিনে ফেরা: ১১:১৫–৬:১৫
- বিকেলে ২০ মিনিট পাওয়ার ন্যাপ (৪টার আগে)
বোনাস:
- সন্ধ্যা ৬টার পর কফি/চা কমান
- রাতের খাবার শোয়ার ৩ ঘণ্টা আগে
- নিয়মিত ২০–৩০ মিনিট হাঁটা—ঘুম ও হৃদয়, দু’দিকেই লাভ
মিথ ভাঙুন, নিয়ম বানান
মিথ ১: “শুক্রবার জেগে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ঘুম = হার্ট-হেলথ।”
বাস্তব: এক দিনে অতিরিক্ত ঘুম নয়, সারা সপ্তাহের ঘুমের গুণগত মান গুরুত্বপূর্ণ। ছোট কিন্তু নিয়মিত ক্যাচ-আপ বেছে নিন।
মিথ ২: “আমি কম ঘুমেও ঠিক আছি।”
বাস্তব: সাবক্লিনিকাল ক্ষতি চোখে পড়ে না। ব্লাড প্রেসার/শরীরের ওজন/এনার্জি—সবই ধীরে বদলায়।
মিথ ৩: “ঘুম শুধু মস্তিষ্কের জন্য।”
বাস্তব: ঘুম হলো হার্ট, হরমোন, সুগার, প্রদাহ—সব কিছুর রিসেট।
‘স্মার্ট ঘুম’ হলেই ‘স্ট্রং হার্ট’
বাংলাদেশের জীবন-ছন্দে রাত জাগা, ফজর, অফিস, ট্রাফিক—সব মিলিয়ে নিখুঁত ঘুম পাওয়া কঠিন। তবু ছোট ছোট বদলেই বড় লাভ।
- সপ্তাহে ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমকে প্রাধান্য দিন
- না পারলে উইকএন্ডে ১–২ ঘণ্টা ক্যাচ-আপ
- দুপুরের পাওয়ার ন্যাপ
- স্ক্রিন-কারফিউ, শীতল ঘর, ক্যাফেইন-কন্ট্রোল
আসিফের মতো আপনিও শনিবারে যখন অ্যালার্মটা একটু পরে সেট করবেন, মনে রাখুন—এটা অলসতা নয়; এটা আপনার হৃদয়ের প্রতি দায়িত্বশীলতা। আজকের অতিরিক্ত এক ঘণ্টা ঘুম, হয়তো আগামী দিনের একটি বড় বিপদকে ২০% কম করে দিল।
ঘুমকে প্রাধান্য দিন—কারণ সুস্থ হৃদয়ের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ‘ইন্স্যুরেন্স’ এটাই।