“ডিজাইন শুধু দেখতে কেমন তা নয়, কেমনভাবে কাজ করে সেটাও ডিজাইনের অংশ।” এই একটি লাইনে যেন পুরো স্টিভ জবসের দর্শন লুকিয়ে আছে।
আমরা সবাই Apple-এর নাম জানি, তার আইফোন বা ম্যাকবুক হয়তো অনেকেই ব্যবহার করি। কিন্তু এই অসাধারণ প্রোডাক্টগুলোর পেছনে যে মানুষটি ছিলেন—তিনি শুধু একজন ব্যবসায়ী নন, ছিলেন একদম অন্যরকম এক চিন্তাশীল শিল্পী। নাম তার—স্টিভ জবস। চলুন দেখি, কী ছিল তার সেই মাইন্ডসেট, আর কীভাবে এই ভাবনা বাংলাদেশের তরুণদের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।
১. পারফেকশন নিয়ে অবসেশন—not optional, but essential
স্টিভ জবস এমন একজন ছিলেন, যিনি একটি আইফোনের স্ক্রিনের কোণার গোলত্ব পর্যন্ত নিয়ে ভাবতেন! একটি প্রোডাক্ট হাতে নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা যেন “ম্যাজিকের মতো” হয়—এই ছিল তার লক্ষ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, “ডিটেইলস matter করে।”
একবার Apple এর মাদারবোর্ড ডিজাইন করছিলেন তার টিম। সেটা তো বাইরে থেকে কেউ দেখবে না। কিন্তু স্টিভ জবস এসে বললেন, “ভেতরের অংশটাও সুন্দর হতে হবে। কারণ আমরা জানবো যে সেটা কেমন।” এই ‘অদৃশ্য সৌন্দর্য’ তৈরি করার মানসিকতাই Apple-কে সবার থেকে আলাদা করেছে।
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য পাঠ:
কোনো কিছু শুধু ‘হয়ে গেছে’ টাইপে বানিয়ে ফেলা যথেষ্ট নয়। আপনি যদি সত্যিই আলাদা হতে চান, তাহলে পারফেকশনকে ভালোবাসতে হবে।
২. ডিজাইন হলো অনুভবের জগৎ—শুধু রঙ বা ফন্ট নয়
স্টিভ জবস বারবার বলতেন, “Design is not just what it looks like. Design is how it works.” তিনি প্রোডাক্ট ডিজাইনারদের বলতেন—“তোমরা এমনভাবে ডিজাইন করো, যেন চোখ বন্ধ করেও একজন মানুষ বুঝতে পারে কোথায় কী আছে।”
Apple-এর একটি বাক্স খোলার সময় যে অনুভূতি হয়, সেটাও ছিল তার ডিজাইনের অংশ। শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়, অনুভবই ছিল তার প্রোডাক্টের মূল জাদু।
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য পাঠ:
আপনি ওয়েবসাইট বানান, অ্যাপ বানান, বা দোকানের ডিজাইন করেন—ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা (user experience) বুঝে ডিজাইন করুন। শুধু চটকদার না, চিন্তাধারার ছাপ থাকুক আপনার ডিজাইনে।
৩. ইনোভেশন মানে নতুন কিছু, শুধু টেকনোলজি না—চিন্তাধারারও ভিন্নতা
স্টিভ জবস একবার বলেছিলেন, “Creativity is just connecting things.”
তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জেন স্কুলের ক্যালিগ্রাফি ক্লাস, আর প্রযুক্তি—এই তিন জগতকে মিশিয়ে বানিয়েছিলেন Macintosh। তার ইনোভেশন ছিল জটিল জিনিসকে সহজ করে তোলা।
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য পাঠ:
ইনোভেশন মানেই নিউক্লিয়ার ফিজিক্স না। আপনি যেকোনো সাধারণ সমস্যার জন্য ভিন্নধারার সমাধান খুঁজলে সেটাও ইনোভেশন। যেমন, 10 Minute School আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইনোভেশন এনেছে ভিডিওতে ক্লাস দিয়ে।
আপনার চিন্তাই হতে পারে আগামী দশকের নতুন দরজা।
৪. “না” বলা শিখুন—সফলতা আসে ফোকাস থেকে
স্টিভ জবস একবার বলেছিলেন, “Innovation is saying ‘no’ to a thousand things.”
Apple যখন iPhone বানাচ্ছিল, তখন শত রকম ফিচার সাজেশন ছিল। কিন্তু জবস বলেছিলেন—“সেরা ব্যবহার অভিজ্ঞতার জন্য অপ্রয়োজনীয় সব বাদ দাও।” তাঁর মতে, “ফিচার নয়, ফোকাস”-ই সফলতার চাবিকাঠি।
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য পাঠ:
আপনি যখন কিছু শুরু করবেন—দশদিক থেকে দশজন দশ কথা বলবে। কিন্তু আপনি যদি নিজের লক্ষ্যটা পরিষ্কার না রাখেন, তাহলে হারিয়ে যাবেন। Markopolo.ai, Chaldal, কিংবা ShopUp—এই কোম্পানিগুলোর সাফল্যের পেছনেও রয়েছে পরিষ্কার ফোকাস।
৫. বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে ‘ডিজাইন-চিন্তা’র রূপরেখা কেমন হতে পারে?
বাংলাদেশে ডিজাইন মানে এখনো অনেকের কাছে “দেখতে সুন্দর” কিছু বানানো। কিন্তু স্টিভ জবসের চিন্তাধারায় ডিজাইন মানে—
- মানুষের অভিজ্ঞতাকে সহজ করা
- প্রযুক্তির মধ্যে সৌন্দর্য আনা
- সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান খোঁজা
এই চিন্তাধারা যদি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা, উদ্যোক্তারা এবং ডিজাইনাররা আত্মস্থ করেন, তাহলে “Made in Bangladesh” শুধু পোশাক না, হতে পারে বিশ্বমানের ডিজিটাল পণ্যও।
“Think different”—শুধু স্লোগান নয়, জীবনের দর্শন
স্টিভ জবসের প্রতিটি কাজ যেন বলতো, “ভিন্নভাবে ভাবো।” তাঁর সফলতা টাকার জন্য নয়, তিনি চাইতেন মানুষকে বদলে দিতে, প্রযুক্তিকে ভালোবাসায় রূপ দিতে।
এখন, প্রশ্ন হলো—আপনি কীভাবে ভাবছেন?
- আপনি কি স্রোতের সাথে যাচ্ছেন?
- নাকি নিজের চিন্তাকে সত্যি করতে সাহস রাখছেন?
স্টিভ জবস হয়তো আর বেঁচে নেই, কিন্তু তার দেখানো পথ, তার মাইন্ডসেট—আজো পথ দেখাতে পারে কোটি কোটি তরুণকে, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের সাহসী স্বপ্নবাজদের।
আপনার ডিজাইন হোক শুধু রঙিন না, হোক চিন্তাশীল। আপনার আইডিয়া হোক শুধু ফিচার নয়, হোক অনুভব। আপনার ভবিষ্যৎ হোক শুধু চাকরি খোঁজার না, হোক পৃথিবী বদলানোর। স্টিভ জবসের মতো করে নয়, নিজের মতো করে ভাবুন—কিন্তু ভাবুন ভিন্নভাবে।