“ব্যবসা করতে চাই, কিন্তু তো কিছুই নেই—না টাকা, না বড় আইডিয়া, না কোনো অভিজ্ঞতা।”
এই কথাটা আমাদের অনেকের মুখে শোনা যায়, বিশেষ করে যেসব নারী ঘরে বসে কিছু শুরু করতে চান। কিন্তু যদি বলি, এক নারী মাত্র ৫ হাজার ডলার আর একটা সাধারণ সমস্যাকে সমাধান করতে গিয়ে তৈরি করেছিলেন একটা বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি?
হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমরা কথা বলছি সারা ব্লেকলি (Sara Blakely) এবং তার প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ব্র্যান্ড Spanx নিয়ে।
এই গল্প শুধু ফ্যাশন ব্র্যান্ড গড়ার গল্প না, বরং এটা বিশ্বাস, চেষ্টা আর অদম্য সাহসের এক জ্বলন্ত উদাহরণ—যা বাংলাদেশের হাজারো নারীকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে।
শুরুর দিন—একজন সাধারণ নারী, এক সাধারণ সমস্যা
সারা ব্লেকলি ছিলেন একজন সেলসগার্ল। তিনি কসমেটিক্স বিক্রি করতেন দোকানে দোকানে ঘুরে। কিন্তু প্রতিদিন অফিসে গিয়ে যখন তিনি প্যান্টস পরতেন, তখন একটা সমস্যা হতো—প্যান্টের নিচে “লাইন” দেখা যেত। যতই ভালো জামা পড়ুন না কেন, এই এক সমস্যা সব সৌন্দর্য নষ্ট করে দিত।
তখনই তাঁর মাথায় আসে এক আইডিয়া—“কেন এমন একটা আন্ডারওয়্যার বানানো যাবে না, যা শরীরকে স্মুথ করবে, আর বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাবে না?”
একটা সাধারণ সমস্যা। কিন্তু তার সমাধানেই লুকিয়ে ছিল বিলিয়ন ডলারের সুযোগ।
রান্নাঘরের টেবিলেই শুরু হয় ‘Spanx’
সারার পকেটে ছিল মাত্র ৫০০০ ডলার। তিনি কোনো ফ্যাশন ডিজাইনার না, কোনো বিজনেস গ্র্যাজুয়েটও না। কিন্তু ছিল একটাই জিনিস—বিশ্বাস। তিনি নিজে হাতে ডিজাইন করে, ফ্যাব্রিক কিনে, রান্নাঘরের টেবিলেই কাটাকাটি করে বানাতে শুরু করলেন প্রথম স্প্যানক্স প্রোটোটাইপ।
তারপর শুরু করলেন নানা কোম্পানিতে গিয়ে পিচ করা। সবাই বলল, “নারী পোশাক নিয়ে ব্যবসা কঠিন। কেউ কিনবে না।” তবুও থামলেন না। অবশেষে এক ছোট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রাজি হলো বানাতে। তৈরি হলো প্রথম স্প্যানক্স প্রোডাক্ট।
বিক্রি কীভাবে শুরু করলেন?
সারা ব্লেকলি নিজেই ভিজিট করতেন দোকানে দোকানে। বুটিক শপে গিয়ে বলতেন, “এইটা নতুন একটা আন্ডারগার্মেন্ট, ট্রাই করে দেখুন।” নিজের প্রোডাক্ট নিজেই পরে দেখাতেন। এমনকি একবার Neiman Marcus নামক বড় চেইন স্টোরে গিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে পরে দেখিয়ে বলেছিলেন, “দেখুন পার্থক্যটা।” ওই সময় কেউ যদি তাঁকে বলতো—“এইটা তো ঠিক ব্যবসা না”—তাহলে তিনি হয়তো আজকের সারা হতেন না।
এক রাতেই পালটে যায় ভাগ্য
একদিন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপিকা Oprah Winfrey বললেন, তিনি Spanx ব্যবহার করেন এবং এটা তাঁর “Top Favorite Things”-এর একটি। সেই একটাই ঘোষণায় স্প্যানক্সের অর্ডার বেড়ে যায় কয়েক হাজার গুণ। আর সারা ব্লেকলি হয়ে যান আমেরিকার সবচেয়ে কম বয়সী সেল্ফ-মেইড বিলিয়নিয়ার নারী।
বাংলাদেশি নারীদের জন্য এই গল্পের শিক্ষা কী?
বাংলাদেশে অনেক নারী ঘরে বসে থাকে—কারও সংসার, কারও সন্তান, কারও সামাজিক বাধা। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র বীজ থাকে—“আমি কিছু করতে চাই।”
সারা ব্লেকলির মতো গল্প প্রমাণ করে—
- ব্যবসা করতে মাস্টার্স লাগেনা
- আইডিয়া ছোট হলেও সেটা বড় হতে পারে
- রান্নাঘর থেকে শুরু করেও আপনি গ্লোবাল হতে পারেন
- টাকা না থাকলেও, সমস্যা বুঝে সমাধান দিতে পারলেই বিজয় সম্ভব
সারা ব্লেকলির ৩টি মন্ত্র যা আপনি মেনে চলতে পারেন
১. “Don’t be afraid to fail.”- তিনি বলতেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর বাবা তাঁকে বলতেন—“আজকে কীতে ফেল করলি?” অর্থাৎ, তিনি শেখেন ভয় নয়, চেষ্টা করাই আসল জিনিস।
২. “Sell your idea like your life depends on it.”- সারা নিজেই প্রতিটি দোকানে গেছেন, নিজে বুঝিয়েছেন, নিজে ব্র্যান্ড বানিয়েছেন।
৩. “Start before you’re ready.”- তিনি বিশ্বাস করতেন, সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার অপেক্ষা করলে কিছুই শুরু হবে না। যা আছে, তাই নিয়ে শুরু করো।
বাংলাদেশের রান্নাঘর থেকেও তৈরি হচ্ছে ব্র্যান্ড
আপনি কি জানেন—ঢাকার মিরপুরে এক নারী নিজের কিচেনে শুরু করেছিলেন মধু, আচার আর ঘরে তৈরি খাবার বিক্রি? আজ তাঁর “HomeChef BD” ফেসবুক পেজে হাজার হাজার ফলোয়ার। তিনি প্রতিদিন ঘরে বসে কয়েক ডজন অর্ডার পাচ্ছেন।
নতুন অনেক নারীরা অনলাইন কেক ব্যবসা, শাড়ির পেজ, থ্রিফট স্টোর, হ্যান্ডক্র্যাফটেড জুয়েলারি নিয়ে কাজ করছেন। তাদের পথ সহজ না। কিন্তু বিশ্বাস আছে।
রান্নাঘর থেকে শুরু করে রণক্ষেত্রে জয়
সারা ব্লেকলি দেখিয়ে দিয়েছেন—একজন নারী, একটা আইডিয়া আর একটু সাহস থাকলে সবকিছু সম্ভব। আপনি যদি আজ শুধু ভাবেন—“আমার হাতের কাজটা হয়তো কেউ পছন্দ করবে না”, তাহলে একবার সারা ব্লেকলির কথা মনে করুন।
“নিজের গল্প নিজেই লিখতে হয়। শুরুটা ছোট হলেও, শেষটা হতে পারে অসাধারণ।”