একবার ভাবুন—আপনি পরিবার নিয়ে টেবিলে বসেছেন। খাবার আছে, গরম ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু সবার চোখ মোবাইল স্ক্রিনে।
“একটু দেখি, একটা ভিডিও বাকি আছে।”
“মেসেজটা রেপ্লাই দিই, তারপর খাচ্ছি।”
খাওয়ার সময় মোবাইল দেখা আজকের দিনে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু জানেন কি, এই অভ্যাস আপনার শরীরের ৩০% পুষ্টি শোষণ কমিয়ে দিতে পারে? শুধু তাই নয়, পারিবারিক বন্ধন ও মানসিক শান্তির ওপরও পড়ছে মারাত্মক প্রভাব।
মোবাইল কেন পুষ্টির শত্রু হতে পারে?
খাবার খাওয়ার সময় মস্তিষ্কে সিগন্যাল যায়, স্যালাইভা (লালা) তৈরি হয়। এই লালা খাবারের প্রথম ধাপে হজমে সহায়তা করে। কিন্তু যখন আপনার মনোযোগ স্ক্রিনে, তখন মস্তিষ্ক সঠিক সিগন্যাল দেয় না। ফলে—
- স্যালাইভা তৈরি কমে যায়।
- দরকারি হজম এনজাইম তৈরি হয় না।
- খাবার সঠিকভাবে ভেঙে শরীরে শোষিত হয় না।
একটি গবেষণায় (Journal of Health Psychology) দেখা গেছে, খাওয়ার সময় বিভ্রান্তি বা “Mindless Eating” কেবল পুষ্টি কমায় না, বরং আপনাকে বেশি খেতে বাধ্য করে। অর্থাৎ, অতিরিক্ত ক্যালরি জমে ওজনও বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশি পরিবারের বাস্তবতা
ঢাকার গৃহিণী তানিয়া আপা বলেন—
“আমার বাচ্চারা খেতে বসে ইউটিউব না দেখলে মুখে খাবারই দেয় না। আগে মনে করতাম এটাই সমাধান। কিন্তু এক সময় দেখি, খাওয়ার পর পেট ব্যথা, হজম সমস্যা বাড়ছে। তখন বুঝলাম—মোবাইল খাওয়ার সময় একেবারেই ক্ষতিকর।”
চট্টগ্রামের আহাদ ভাই জানান—
“আমি অফিসের কাজের জন্য খাওয়ার সময় ফোন ব্যবহার করতাম। একদিন ডাক্তার বললেন আমার গ্যাস্ট্রিক সমস্যার কারণ হতে পারে খাওয়ার সময় স্ক্রিনে মনোযোগ। এরপর থেকে খাওয়ার সময় ফোন দূরে রাখি।”
বিজ্ঞান কী বলে?
১. হজমে ব্যাঘাত: ফোনে ভিডিও দেখলে বা কাজ করলে মস্তিষ্ক খাবারের প্রতি ফোকাস কমায়। ফলে পেট খাবার ভাঙতে বেশি সময় নেয়।
২. স্ট্রেস হরমোন বাড়ায়: ফোনের নোটিফিকেশন বা স্ক্রলিংয়ের চাপ কোর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা হজম কমিয়ে দেয়।
৩. অতিরিক্ত খাওয়া: ফোনে মনোযোগ থাকায় আপনি কতটা খাচ্ছেন তা বোঝা কঠিন হয়, ফলে অপ্রয়োজনীয় ক্যালরি জমে।
মোবাইল ছাড়া খাওয়ার উপকারিতা
- ভালো হজম: খাবারের প্রতি মনোযোগ থাকলে লালা ও এনজাইম ঠিকমতো কাজ করে।
- কম খাওয়া: মস্তিষ্ক দ্রুত সিগন্যাল দেয় যে পেট ভরে গেছে।
- পরিবারের বন্ধন: টেবিলে আড্ডা হয়, সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
- মানসিক প্রশান্তি: মনোযোগী হয়ে খাওয়ার ফলে খাবারের স্বাদ ও আনন্দ বেড়ে যায়।
খাওয়ার সময় মোবাইল ছাড়া থাকার ৫টি সহজ টিপস
১. খাওয়ার আগে ফোন সাইলেন্ট করুন:
এক ঘণ্টার জন্য নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন।
২. ‘ফোন-ফ্রি ডাইনিং’ নিয়ম চালু করুন:
পুরো পরিবার মিলে টেবিলে ফোন ছাড়া বসুন।
৩. খাবারের সময় নতুন কিছু শিখুন:
টেবিলে একে অপরের দিনের অভিজ্ঞতা বা গল্প শেয়ার করুন।
৪. টাইমার ব্যবহার করুন:
২০-৩০ মিনিট শুধু খাওয়ার জন্য নির্ধারিত সময় দিন।
৫. ধীরে খাওয়ার অভ্যাস করুন:
প্রতিটি কামড় ২০ বার চিবিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন।
শিশুদের ক্ষেত্রে করণীয়
শিশুদের হাতে ফোন দিয়ে খাওয়ানো সমস্যার মূল কারণ। এটার পরিবর্তে—
- ছোট গল্প বলুন বা গান শুনান।
- শিশুকে খাওয়ার সময় খাবারের রং, গন্ধ, স্বাদ বোঝাতে চেষ্টা করুন।
- মডেলিং করুন: আপনি যদি ফোন ছাড়েন, শিশুরাও ছাড়বে।
মনোযোগী খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন (Mindful Eating)
বিশ্বজুড়ে আজ Mindful Eating একটি স্বাস্থ্যকর ট্রেন্ড। অর্থাৎ, খাবারের রং, গন্ধ, স্বাদ, প্রতিটি কামড়ে মনোযোগ দিন।
- এভাবে আপনি কম খাবেন।
- খাবার বেশি উপভোগ করবেন।
- হজম ভালো হবে এবং পুষ্টি সর্বোচ্চভাবে শোষিত হবে।
খাওয়ার সময় ফোন দেখা হয়তো এখন আপনার কাছে ছোট্ট একটি অভ্যাস মনে হচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা আপনার শরীরের পুষ্টি শোষণে প্রভাব ফেলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভ্রান্ত অবস্থায় খাওয়া পুষ্টির কার্যকারিতা ২০-৩০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
তাই আজ থেকেই খাবারের সময় ফোন দূরে রাখুন। পরিবারের সাথে গল্প করুন, ধীরে খাবার উপভোগ করুন। দেখবেন, পেটের সমস্যা, হজমের অসুবিধা কমে গেছে এবং খাবারের স্বাদ আগের চেয়ে ভালো লাগছে।