আমরা সবাই “মন” শব্দটা ব্যবহার করি। “মন ভালো নেই”, “মন থেকে বলছি”, “মন দিয়ে শোনো”—এই কথাগুলো আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। আমরা প্রেম, ঘৃণা, ভয়, আশা, বা আনন্দ অনুভব করি—এ সবই আমাদের ‘মনে’ ঘটে।
কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন, এই ‘মন’ জিনিসটা আসলে কী?
একজন সার্জন যখন ব্রেন অপারেশন করেন, তিনি দেখতে পান প্রায় দেড় কেজি ওজনের একটি জটিল অঙ্গ—অসংখ্য রক্তনালী, স্নায়ুকোষ (নিউরণ) আর টিস্যু। তিনি ব্রেনের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করতে পারেন, কিন্তু তিনি কি কখনো “চিন্তা”, “ভালোবাসা” বা “দুঃখ” স্পর্শ করতে পারেন?
না। তাহলে আমাদের এই সব অনুভূতি, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের চেতনা—এই ‘মন’—ব্রেনের ঠিক কোন কোণায় থাকে?
হার্ডওয়্যার বনাম সফটওয়্যার: ব্রেন ও মনের পার্থক্য
সহজভাবে বোঝার জন্য, আমরা ব্রেনকে একটি কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার (Hardware) হিসেবে ভাবতে পারি। এটি একটি বাস্তব, দৃশ্যমান অঙ্গ—যা নিউরন, সিন্যাপ্স এবং বৈদ্যুতিক সংকেত দিয়ে তৈরি। এটি আমাদের শরীরের সমস্ত কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক যেমন একটি কম্পিউটারের মাদারবোর্ড, প্রসেসর বা হার্ড ড্রাইভ পুরো সিস্টেমকে চালায়।
অন্যদিকে, ‘মন’ (Mind) হলো সেই কম্পিউটারে চলা সফটওয়্যার (Software) বা ‘অভিজ্ঞতা’। আপনার কম্পিউটারের স্ক্রিনে আপনি যে গেমটি খেলছেন বা যে আর্টিকেলটি পড়ছেন—সেটাই হলো অভিজ্ঞতা। আপনি প্রসেসর বা র্যামকে (RAM) স্পর্শ করতে পারবেন, কিন্তু “গেম” বা “আর্টিকেল”-টিকে কি স্পর্শ করতে পারবেন? পারবেন না।
মন হলো আমাদের চেতনা, চিন্তা, আবেগ, স্মৃতি, এবং আত্ম-সচেতনতা—এই সবকিছুর সম্মিলিত অভিজ্ঞতা। ব্রেন হলো সেই মঞ্চ, আর মন হলো সেই মঞ্চে অভিনীত নাটক।
১৬৩৭ সালে ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত বলেছিলেন সেই বিখ্যাত কথা: “আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।” তিনি বিশ্বাস করতেন, মন এবং শরীর দুটো আলাদা জিনিস—মন হলো অদৃশ্য, অপদার্থ; আর মস্তিষ্ক হলো ভৌত, স্পর্শযোগ্য।
এই ধারণাকে বলা হয় Dualism বা দ্বৈতবাদ।
কিন্তু ২০২৪ সালের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। মনোবিজ্ঞানী আইরিস বেরেন্ট বলেন, “মানুষের মস্তিষ্ক আমাদের সাথে ট্রিক খেলে। আমরা স্বাভাবিকভাবেই মনে করি মন এবং শরীর আলাদা—কিন্তু এটা একটা ভ্রম, যদিও স্বাভাবিক ভ্রম।”
তার মতে, এই দ্বৈতবাদী চিন্তা আমাদের বিবর্তনীয় ইতিহাসের অংশ। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে: মন আলাদা কিছু নয়—মন হলো মস্তিষ্কের কার্যক্রম।
চেতনা কোথায়? বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান
১. সেরিব্রাল কর্টেক্স:
দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, সেরিব্রাল কর্টেক্স হলো “চেতনার আসন”—বিশেষত প্রিফ্রন্টাল এবং প্যারাইটাল এলাকা। এই অংশগুলো সংবেদনশীল তথ্য একীভূত করে এবং নমনীয় চিন্তাপ্রক্রিয়া তৈরি করে যা মানুষের সচেতনতার বৈশিষ্ট্য।
মস্তিষ্ক হলো ৮৬ বিলিয়ন নিউরনের একটি মহাবিশ্ব, প্রতিটি হাজারো অন্য নিউরনের সাথে সংযুক্ত, ট্রিলিয়ন সিন্যাপটিক লিঙ্ক বুনছে। এই জটিলতা থেকেই উদ্ভব হয় চেতনার প্রবাহ।
২. থ্যালামাস:
থ্যালামাস হলো একটি গভীর গঠন যা কর্টেক্সে তথ্য রিলে করে এবং জাগরণ বজায় রাখে। যখন আমরা সচেতন থাকি, নিউরনরা এই নেটওয়ার্কগুলির জুড়ে সমন্বিত ছন্দে ফায়ার করে, দৃষ্টি, শব্দ এবং সংবেদনগুলি একটি সুসংগত পূর্ণতায় বাঁধে।
৩. সাবকর্টেক্স:
কিন্তু ২০২৫ সালের সাম্প্রতিক গবেষণা চমকপ্রদ কিছু বলছে। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট পিটার কপোলা দেখেছেন, সাবকর্টেক্সেই চেতনার ভিত্তি রয়েছে, যখন মস্তিষ্কের আরও সাম্প্রতিক বিবর্তিত অংশ—যেমন নিওকর্টেক্স—চেতনাকে পরিশীলিত করে।
এর প্রমাণ? হাইড্রান্সেফালি নামক একটি বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুরা—যাদের সেরিব্রাম (কর্টেক্সের মূল অংশ) নেই—তবুও কিছুটা সচেতন থাকে। একজন ৩২ বছর বয়সী মহিলা, যার ফ্রন্টাল কর্টেক্সের একটি ছোট অংশ সংরক্ষিত ছিল, তিনি সংগীতে আনন্দিত হাসি এবং শব্দ করতে সক্ষম ছিলেন।
এর মানে? চেতনা শুধু কর্টেক্সে নয়—সাবকর্টেক্সেও আছে।
৪. ব্রেনস্টেম:
ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের একটি ২০২৪ সালের এমআরআই গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রেনস্টেম থেকে কর্টেক্স পর্যন্ত একটি “ডিফল্ট অ্যাসেন্ডিং এরাউজাল নেটওয়ার্ক” রয়েছে যা মানুষের সচেতন মস্তিষ্কে জাগরণ বজায় রাখে।
মানে, চেতনা একক কোনো স্থানে নেই—এটি একটি নেটওয়ার্ক, একটি সিম্ফনি যেখানে বিভিন্ন অংশ মিলে একটি সুর তৈরি করে।
চেতনার “বাইন্ডিং প্রবলেম”
নিউরোসায়েন্সে একটি অমীমাংসিত রহস্য আছে যাকে বলা হয় “Binding Problem”।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন কাজের জন্য দায়ী: কিছু অংশ রং প্রসেস করে, কিছু শব্দ, কিছু স্পর্শ। কিন্তু এসব কীভাবে একসাথে আসে এবং একটি একীভূত উপলব্ধি বা চেতনা তৈরি করে?
তথ্য মস্তিষ্কে এত দ্রুত একসাথে আসে এবং ইন্টারঅ্যাক্ট করে যে এটি নিউরাল ট্রান্সমিশনের বর্তমান বোঝাপড়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
নেদারল্যান্ডসের ড. ডার্ক কে.এফ. মেইজার একটি তত্ত্ব দিয়েছেন: চেতনা মস্তিষ্কের চারপাশের একটি ক্ষেত্রে (field) থাকে। এই ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র এবং অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং মস্তিষ্কের টিস্যুতে তরঙ্গ তথ্য প্রেরণ করে।
এর মানে, মন হয়তো শুধু মস্তিষ্কের ভেতরে নয়—বরং মস্তিষ্কের চারপাশে একটি ফিল্ড হিসেবে আছে!
বিভিন্ন তত্ত্ব:
১. গ্লোবাল ওয়ার্কস্পেস থিওরি
এই তত্ত্ব বলে, চেতনা হলো মস্তিষ্কের একটি “গ্লোবাল ওয়ার্কস্পেস”—যেখানে বিভিন্ন অংশ থেকে তথ্য আসে, প্রসেস হয় এবং পুরো মস্তিষ্কে শেয়ার হয়। এটা অনেকটা একটা স্টেজের মতো—যেখানে বিভিন্ন অভিনেতা (মস্তিষ্কের অংশ) আসে এবং তাদের অভিনয় করে।
২. ইন্টিগ্রেটেড ইনফরমেশন থিওরি
নিউরোসায়েন্টিস্ট জুলিও টোনোনি বলেন, চেতনা হলো “ইন্টিগ্রেটেড ইনফরমেশন”—যত বেশি তথ্য একীভূত হয়, তত বেশি চেতনা।
৩. কোয়ান্টাম কনশাসনেস
পদার্থবিদ রজার পেনরোজ এবং অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট স্টুয়ার্ট হ্যামারফ বলেন, চেতনা হয়তো কোয়ান্টাম লেভেলে ঘটে—মাইক্রোটিউবিউলস নামক কোষীয় গঠনে, যা কোয়ান্টাম এফেক্টের মাধ্যমে চেতনা তৈরি করে।
৪. ফিল্ড থিওরি
কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, চেতনা একটি “মানসিক ক্ষেত্র” যা মস্তিষ্কের চারপাশে থাকে এবং মস্তিষ্কের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করে। এটা অনেকটা চৌম্বক ক্ষেত্রের মতো—যা দেখা যায় না, কিন্তু প্রভাব ফেলে।
মন হলো মস্তিষ্কের একটি সিম্ফনি
মন হলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের একটি সমন্বিত কার্যক্রম—একটি অর্কেস্ট্রা যেখানে প্রতিটি যন্ত্র আলাদা সুর বাজায়, কিন্তু একসাথে মিলে তৈরি হয় একটি সিম্ফনি।
- কর্টেক্স চিন্তা, যুক্তি, ভাষা প্রসেস করে
- সাবকর্টেক্স আবেগ, প্রেরণা তৈরি করে
- ব্রেনস্টেম জাগরণ বজায় রাখে
- থ্যালামাস তথ্য রিলে করে
এবং এই সবকিছু মিলেই তৈরি হয় যাকে আমরা বলি “আমি”, “মন”, বা “চেতনা”।
ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্টিস্ট অনিল সেথ বলেন, “কীভাবে চেতনা ঘটে তা এখনও মৌলিকভাবে রহস্যময়।”
এবং সেটাই হয়তো সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার। আমরা হাজার বছর ধরে খুঁজছি, এখনো খুঁজছি। হয়তো একদিন উত্তর পাব—হয়তো পাব না। কিন্তু এই খোঁজটাই আমাদের মানুষ করে তোলে।
মন হলো সেই অদৃশ্য আলো যার দ্বারা আমরা সবকিছু দেখি। এটা ছাড়া মহাবিশ্ব হয়তো থাকত, কিন্তু অন্ধকার এবং নীরব। এর সাথে, মহাবিশ্ব ভরে ওঠে রঙ, অর্থ এবং ভালোবাসায়।
আর এই রহস্যময় যাত্রায়—নিজেকে খুঁজতে, “আমি” কে জানতে—আমরা কেউই একা নই। প্রতিটি মানুষ এই একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। এবং সেই খোঁজাটাই হয়তো সবচেয়ে মানবিক কাজ।

