“মেয়েরা আবেগপ্রবণ, ছেলেরা বেশি লজিকাল”— এমন কথা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। স্কুলে, পরিবারে, এমনকি অফিসেও এমন মন্তব্য যেন খুব স্বাভাবিক।
তবে আপনি কি জানেন, এইসব কথার পেছনে কতটুকু সত্য?
আর, মস্তিষ্কের আকার বড় মানেই কি বেশি বুদ্ধি?
চলুন, এবার শোনা যাক মস্তিষ্ক নিয়ে কিছু বিজ্ঞান ও বাস্তবতার গল্প, যা অনেক প্রচলিত ধ্যানধারণাকে নতুন আলোয় দেখায়।
একটা রিকশা-ভ্রমণের গল্প দিয়ে শুরু করি…
ঢাকার ধানমন্ডি ২৭ থেকে মিরপুরের দিকে যাচ্ছি। পাশের যাত্রী এক টুকরো ‘দার্শনিক’—বয়স ত্রিশের ঘরে, অফিস করেন আইটি ফার্মে। হঠাৎ মেজাজ গরম করে বললেন,
“বুঝলেন ভাই, মেয়েদের তো মাথা কম চলে, আবেগে বেশি চলে। তাই তাদের দিয়ে লজিকের কাজ হয় না।”
রিকশা থামাতে ইচ্ছা করল, বলি—“এই ধারণাটা আজই বদলে ফেলেন। কারণ, বিজ্ঞান আপনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।”
পুরুষের মস্তিষ্ক বড়, কিন্তু তাতেই কি সব?
বিজ্ঞান বলছে, গড় হিসেবে পুরুষের মস্তিষ্ক নারীর চেয়ে প্রায় ১০% বড়।
এই তথ্যই অনেকের হাতিয়ার—“বড় মস্তিষ্ক = বেশি বুদ্ধি”।
কিন্তু ঠিক এখানেই আসে নতুন তথ্য:
মস্তিষ্কের আকার নয়, বরং সেটার সংযোগ ও কার্যপ্রক্রিয়া একজন মানুষের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা নির্ধারণ করে।
Stanford University-র এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মস্তিষ্কে neural connectivity অনেক বেশি সমন্বিত এবং বাম–ডান হেমিস্ফিয়ারের মধ্যে তথ্য প্রবাহ অনেক দ্রুত। যার অর্থ, নারী মস্তিষ্ক একইসঙ্গে ভাষা, আবেগ, সিদ্ধান্ত ও যুক্তি—সব একসাথে বিশ্লেষণ করতে পারে।
একজন মায়ের উদাহরণেই আসল চিত্র বোঝা যায়…
রাশেদার তিন সন্তান। একজন স্কুলে, একজন ভার্সিটিতে আর ছোটজন সবে হাঁটতে শিখেছে।
এক হাতে রান্না, অন্য হাতে মোবাইল দিয়ে বাচ্চার অনলাইন ক্লাসে লগইন করানো, আর মাথায় রাখছেন বিকেলের বাজারের তালিকা।
সব একসাথে কিভাবে করেন?
এটাই নারী মস্তিষ্কের বিশেষত্ব—মাল্টিটাস্কিং ও সামঞ্জস্যের চূড়ান্ত রূপ।
পুরুষ মস্তিষ্ক কীভাবে আলাদা?
অন্যদিকে, পুরুষদের মস্তিষ্কে সাধারণত এক হেমিস্ফিয়ারের ভেতরে সংযোগ বেশি শক্তিশালী। এর ফলে তারা নির্দিষ্ট একটি কাজে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে পারে।
যেমন:
- দিক নির্ধারণ ও স্থানিক বিশ্লেষণে (spatial awareness) তারা অনেক সময় এগিয়ে
- একটি নির্দিষ্ট সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার প্রবণতা বেশি
তবে সেই সঙ্গে তারা আবেগের সূক্ষ্ম বার্তা অনেক সময় ধরতে পারে না—যা নারীদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি প্রবল।
IQ দিয়ে সব মাপা যায় না—EQ, SQ এর গুরুত্ব
বাংলাদেশের কর্পোরেট দুনিয়াতেও এখন শুধুই IQ নয়, EQ (Emotional Intelligence) আর SQ (Social Intelligence)-এর গুরুত্ব বাড়ছে।
একজন সফল টিম লিডার বা প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে যিনি দলের মন বুঝে চলতে পারেন, দ্বন্দ্ব মেটাতে পারেন, এবং নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন—তিনি বাস্তব জগতে অনেক বেশি কার্যকর।
এখানেই নারীরা অনেক সময় এগিয়ে—তাদের মস্তিষ্কের স্নায়ু সংযোগ আবেগ ও অনুভূতির তথ্য দ্রুত বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়।
মস্তিষ্কের ‘সংগঠন’ই আসল শক্তি—বিজ্ঞান যা বলছে
University of Pennsylvania-র এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মস্তিষ্কে short and long-range connectivity এত বেশি সক্রিয় যে একই সময়ে বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে তারা দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।
নারীদের ক্ষেত্রে ইমোশন, ভাষা ও সিদ্ধান্তগ্রহণ একত্রে কার্যকর হয়।
আর পুরুষদের ক্ষেত্রে হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন, গাণিতিক ও যান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে কিছুটা অগ্রাধিকার থাকে।
এই দুটো বৈশিষ্ট্য পরস্পরের পরিপূরক—তুলনার নয়।
বাঙালি সমাজে এখন দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
বাংলাদেশে এখন নারীরা শিক্ষকতা, ব্যাংকিং, উদ্যোক্তা, এমনকি প্রযুক্তি ও গবেষণার মত ক্ষেত্রেও দারুণ সফল।
তারা প্রমাণ করছে—বুদ্ধি কেবল পরীক্ষার নম্বর বা মস্তিষ্কের আকার দিয়ে মাপা যায় না।
একজন স্কুলশিক্ষিকা, একজন গৃহিণী, একজন নারী চিকিৎসক—তারা প্রতিদিন যে মানসিক ভারসাম্য ও দক্ষতার পরিচয় দেন, তা পুরুষের বড় মস্তিষ্ক নয়, বড় মনের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ।