সোমবার, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
HomeProductivityCareer Developmentক্যারিয়ারে সফল হতে চান? কর্মক্ষেত্রে 'না' বলার কৌশলগুলো জেনে নিন।

ক্যারিয়ারে সফল হতে চান? কর্মক্ষেত্রে ‘না’ বলার কৌশলগুলো জেনে নিন।

কর্মক্ষেত্রে আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই, পরিচিতি পেতে চাই এবং সাহায্যকারী হিসেবে সুনাম কুড়াতে চাই। বিশেষ করে আমাদের সংস্কৃতিতে ‘না’ বলাটা অনেক সময়ই কঠিন মনে হয়। কেউ সাহায্য চাইলে যদি ফিরিয়ে দিই, তাহলে মনে হয় যেন সে আমাকে অপছন্দ করবে বা আমি স্বার্থপর প্রমাণিত হব। এই মানসিকতা নিয়ে অনেকেই অন্যের কাজে হাত বাড়িয়ে দেন, নিজের কাজ ফেলে রেখেও।

কিন্তু আপনি কি জানেন, কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাহায্য করার প্রবণতা অনেক সময় আপনার নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে? হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও, এটি বাস্তব। কীভাবে এই ‘অতিরিক্ত ভালোমানুষী’ আপনার ক্ষতি করছে এবং কখন ‘না’ বলতে শেখাটা জরুরি, তা নিয়েই আজ আলোচনা করব।

ভালো কর্মী বনাম অতিরিক্ত সাহায্যকারী কর্মী

আপনি হয়তো ভাবছেন, সাহায্য করা তো ভালো গুণ। এতে তো আমার সুনাম বাড়ার কথা। অবশ্যই, সাহায্য করা একটি মহৎ গুণ। দলগত কাজে একে অপরের প্রতি সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি সূক্ষ্ম রেখা আছে, যা একজন ভালো কর্মী এবং একজন অতিরিক্ত সাহায্যকারী কর্মীর মধ্যে পার্থক্য গড়ে তোলে।

একজন ভালো কর্মী হলেন তিনি, যিনি নিজের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন এবং প্রয়োজনে অন্যকে বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে সাহায্য করেন, যা তার নিজের উৎপাদনশীলতা বা কাজের মানকে প্রভাবিত করে না। অন্যদিকে, অতিরিক্ত সাহায্যকারী কর্মী প্রায়শই নিজের কাজ ফেলে রেখে অন্যের কাজ করে দেন, অন্যের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন, এবং এর ফলস্বরূপ নিজেই কাজের চাপে জর্জরিত হন।

উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনার সহকর্মী নিয়মিত আপনার কাছে এসে তার প্রেজেন্টেশন স্লাইড বানিয়ে দিতে বলেন, বা তার রিপোর্টের ভুল ধরিয়ে দিতে বলেন। প্রথম প্রথম আপনি হয়তো সানন্দে করে দিলেন। কিন্তু যখন এটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন আপনার নিজের কাজ কখন করবেন? আপনার নিজের কাজের ডেডলাইন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন আপনি আবিষ্কার করেন যে অন্যের কাজ করতে গিয়ে আপনার নিজের কাজই শেষ হয়নি।

কেন অতিরিক্ত সাহায্য করা আপনার ক্যারিয়ারের ক্ষতি করে?

১. নিজের কাজের মান কমে যাওয়া:

যখন আপনি অন্যের কাজ করতে গিয়ে নিজের সময় ও শক্তি ব্যয় করেন, তখন আপনার নিজের কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যায়। এর ফলে আপনার কাজের মান খারাপ হতে পারে, বা আপনি সময়মতো কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হতে পারেন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আপনার কর্মদক্ষতাকে নেতিবাচকভাবে বিচার করতে পারেন।

২. সময় ব্যবস্থাপনায় সমস্যা:

আপনার নিজের কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকে। অন্যের কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিলে আপনার সময় ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ পড়ে। আপনি অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হন, যা আপনার ব্যক্তিগত জীবনকেও প্রভাবিত করে। রাতের পর রাত জেগে কাজ করা, ছুটির দিনেও অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা—এগুলো অতিরিক্ত সাহায্য করারই ফল।

৩. দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব:

আপনি যখন নিয়মিত অন্যের কাজ করে দেন, তখন সেই ব্যক্তি নিজের দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পায় না। একই সাথে, আপনার নিজেরও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আপনি নিজের মূল কাজগুলো ভালোভাবে শেষ করতে পারছেন না বলে আপনার ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ তৈরি হতে পারে।

৪. দায়িত্বের বিভাজন:

অতিরিক্ত সাহায্য করার কারণে অনেক সময় আপনার দায়িত্ব এবং সহকর্মীর দায়িত্বের মধ্যে একটি অস্পষ্টতা তৈরি হয়। এর ফলে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে না কে আসলে কোন কাজটি করছে। যখন সাফল্যের ভাগ আসে, তখন হয়তো আপনি তার ন্যায্য অংশ নাও পেতে পারেন, কারণ কাজের আসল কৃতিত্ব চলে যায় যার মূল দায়িত্ব ছিল তার কাছে।

৫. বার্নআউট এবং মানসিক চাপ:

ক্রমাগত অন্যের কাজের চাপ বহন করা আপনাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে। এটি ‘বার্নআউট’-এর দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে আপনি কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং মানসিক চাপে ভোগেন।

কখন এবং কিভাবে ‘না’ বলবেন?

‘না’ বলাটা সহজ নয়, বিশেষ করে যখন আপনি একজন বাঙালি হিসেবে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে অভ্যস্ত। তবে কিছু কৌশল অবলম্বন করে আপনি সুন্দরভাবে ‘না’ বলতে পারেন, যা আপনার সম্পর্ক নষ্ট করবে না, বরং আপনার পেশাদারিত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

১. সময় নিন:

যখন কেউ আপনাকে কোনো কাজ করার জন্য অনুরোধ করে, তখন তাৎক্ষণিকভাবে ‘হ্যাঁ’ না বলে কিছুটা সময় নিন। বলতে পারেন, “আমাকে একটু দেখতে দিন, আমার এখনকার কাজের ডেডলাইন কী আছে।” এটি আপনাকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার সুযোগ দেবে।

২. নম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করুন:

সরাসরি ‘না’ বলার পরিবর্তে একটি নম্র উত্তর দিন। যেমন: “আমি এই মুহূর্তে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত আছি, তাই এই কাজটি নিতে পারছি না।” অথবা “আমার আজকের দিনের শিডিউল পুরোপুরি ভরা, অন্য কোনো সময় হলে হয়তো দেখতে পারতাম।”

৩. বিকল্প প্রস্তাব দিন:

যদি সম্ভব হয়, একটি বিকল্প প্রস্তাব দিন। যেমন: “এই কাজটি আমি হয়তো এখন করতে পারছি না, তবে এই বিষয়ে এক্স (অন্য একজন) আপনাকে হয়তো সাহায্য করতে পারবে।” অথবা “আমি এই কাজটির কিছু অংশ আপনাকে দেখিয়ে দিতে পারি, বাকিটা আপনি নিজেই করতে পারবেন।”

৪. কারণ ব্যাখ্যা করুন, কিন্তু অতিরিক্ত নয়:

কেন আপনি ‘না’ বলছেন, তার একটি সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট কারণ দিন। তবে মনে রাখবেন, আপনাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে হবে না, বা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে না। শুধু বলুন যে আপনার কাছে সময় নেই বা আপনার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।

৫. নিজের অগ্রাধিকার ঠিক রাখুন:

আপনার নিজের কাজের অগ্রাধিকার কী, তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। যখন কোনো সহকর্মী আপনার কাছে অতিরিক্ত সাহায্য চায়, তখন মনে করুন আপনার নিজের কাজের ডেডলাইন এবং গুরুত্বের কথা। আপনার নিজের ক্যারিয়ারকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।

৬. ‘না’ বলার অভ্যাস করুন:

প্রথমবার ‘না’ বলাটা কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি একটি অভ্যাসে পরিণত হবে। মনে রাখবেন, ‘না’ বলাটা আপনার অক্ষমতা নয়, বরং আপনার সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা এবং আত্মসম্মানের পরিচয়।

রফিক সাহেব তার অফিসের একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। সবাই জানে, রফিক সাহেবকে কিছু বললে তিনি ‘না’ বলেন না। ফলে তার নিজের কাজের পাশাপাশি প্রায়শই সহকর্মীদের কাজও তাকে করে দিতে হতো। তার নিজের প্রমোশনের সময় যখন আসলো, তখন তার বস তাকে ডেকে বললেন, “রফিক সাহেব, আপনি খুবই পরিশ্রমী, কিন্তু আপনার নিজের কাজ শেষ করতে কেন যেন সবসময় দেরি হয়। আর আপনার মূল প্রজেক্টগুলোর রিপোর্টগুলোও মাঝে মাঝে অগোছালো থাকে।” রফিক সাহেব বুঝলেন, অতিরিক্ত ভালোমানুষী তার নিজেরই ক্ষতি করছে। এরপর তিনি ধীরে ধীরে ‘না’ বলতে শিখলেন এবং নিজের কাজে আরও মনোযোগ দিলেন। এক বছর পর তার ঠিকই প্রমোশন হলো।

কর্মক্ষেত্রে ‘না’ বলতে শেখাটা একটি দক্ষতা, যা আপনার ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। এটি আপনাকে আপনার সময়কে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে, কাজের চাপ কমাতে এবং আপনার নিজের কাজকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে সাহায্য করবে। মনে রাখবেন, অন্যের সাহায্য করার আগে নিশ্চিত করুন যে আপনি আপনার নিজের যত্ন নিচ্ছেন এবং আপনার নিজের কাজের প্রতি সুবিচার করছেন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular