সফল ফাউন্ডার হতে হলে আপনার ভেতরে থাকতে হবে দুইটা চরিত্র—একজন আর্টিস্ট, আর একজন অ্যানালিস্ট

রুমানার বয়স তখন ২৬। চাকরি করছিলেন ঢাকায় এক নামকরা ফার্মে। কিন্তু তার মনে চলছিল একটাই প্রশ্ন: “আমি কি সারা জীবন শুধু অন্যের নিয়ম মেনে চলবো? না নিজের একটা স্বপ্ন তৈরি করবো?”

এই প্রশ্ন থেকেই শুরু তার উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা। কিন্তু সফল হতে পারলেন তখনই, যখন বুঝতে পারলেন—শুধু আইডিয়া থাকলেই হয় না, বা শুধু হিসাব করে চললেই চলে না। এই দুইয়ের মিশ্রণই গড়ে তোলে একজন আসল ফাউন্ডার।

আর্টিস্ট—যে স্বপ্ন দেখে, অনুভব করে, তৈরি করে

একজন ফাউন্ডারের ভিতর প্রথম যে জিনিসটা দরকার, সেটা হলো আর্তস মাইন্ডসেট।

একজন আর্টিস্ট কল্পনা করে, অনুভব করে, সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান খোঁজে। তার চিন্তা সীমাবদ্ধ নয়—সে “what if?” দিয়ে ভাবতে ভালোবাসে। উদ্ভাবনের পেছনে তার মস্তিষ্ক জ্বলজ্বল করে।

• আপনি যদি ফাউন্ডার হিসেবে নতুন কোনো প্রোডাক্ট বানাতে চান, তাহলে আপনাকে কল্পনা করতে হবে একজন ইউজারের মতো।
  
• আপনাকে ভাবতে হবে ডিজাইনের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, ব্র্যান্ড কেমন হবে, মানুষ কীভাবে তা গ্রহণ করবে।
  

বাংলাদেশে অনেক সফল স্টার্টআপ—Pathao, 10 Minute School, ShopUp—সব জায়গায়ই আপনি পাবেন সেই কল্পনাপ্রবণ চিন্তার ছাপ। যারা “সমস্যা” দেখে, সেটাকে ভেঙে নতুনভাবে সাজায়।

একজন আর্টিস্ট ফাউন্ডার:

• সমস্যা দেখে আবেগ দিয়ে
  
• সমাধান তৈরি করে কল্পনার জগত থেকে
  
• নান্দনিকতায় বিশ্বাস রাখে
  
• ভোক্তার দৃষ্টিতে চিন্তা করে
  

অ্যানালিস্ট—যে বাস্তবতা বোঝে, ডেটা পড়ে, সিদ্ধান্ত নেয়

কিন্তু ফাউন্ডার হতে হলে শুধু আবেগ দিয়ে হয় না। কারণ ব্যবসা তো শুধু স্বপ্ন নয়, এটা একটা বাস্তব খেলা। এখানে টাকা ইনভেস্ট করতে হয়, হিসাব রাখতে হয়, মানুষ নিয়োগ দিতে হয়, কাস্টমার ধরে রাখতে হয়।

এইখানেই দরকার অ্যানালিস্ট মাইন্ডসেটের।

একজন অ্যানালিস্ট:

• ডেটা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়
  
• মার্কেট ট্রেন্ড বোঝে
  
• প্রতিযোগীদের অ্যানালাইসিস করে
  
• বাজেট, কস্টিং, কনভারশন রেট—সব মনিটর করে
  

ধরুন আপনি একটা নতুন পণ্যের জন্য বিজ্ঞাপন চালাচ্ছেন। একজন আর্টিস্ট বলবে—“এই ক্যাম্পেইনটা দারুণ লাগছে!” কিন্তু একজন অ্যানালিস্ট বলবে—“এটা কতজন রিচ করছে? কনভারশন কত? ROAS কত?”

এই দুইয়ের মিশ্রণেই তৈরি হয় আসল উদ্যোক্তা

ফাউন্ডার মানেই কেবল CTO বা CEO নয়। একজন ফাউন্ডার হতে গেলে আপনাকে স্বপ্ন দেখতে জানতে হবে এবং সেই স্বপ্নে কীভাবে টিকে থাকতে হয়, সেই হিসাবও রাখতে জানতে হবে।

• আর্টিস্ট আপনাকে দেবে দিকনির্দেশনা, কল্পনা ও কনভিকশন
  
• অ্যানালিস্ট আপনাকে দেবে প্ল্যান, মেজারমেন্ট ও স্কেলিংয়ের পথ
  

এই দুইজন যদি এক ব্যক্তির ভেতরে থাকে, তাহলে তিনি যেমন “জানি কীভাবে বানাতে হয়” বলেন, তেমনি “জানি কত টাকায়, কোন মার্কেটের জন্য, কতদিনে” এটাও বুঝেন।

কিভাবে আপনি নিজের মধ্যে এই দুই চরিত্র গড়ে তুলবেন?

১. নিজেকে প্রশ্ন করুন—আপনি কোন দিকে দুর্বল?

আপনি যদি স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেন কিন্তু প্ল্যান করতে ভয় পান, তাহলে আপনি বেশি আর্টিস্ট। আবার আপনি যদি সব হিসাব ভালো পারেন কিন্তু নতুন আইডিয়া আনতে পারেন না, তাহলে আপনি অ্যানালিস্ট টাইপ।

উভয়দিকেই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারেন:

• আর্টিস্ট সাইড ডেভেলপ করতে: বই পড়ুন (Creativity Inc, The War of Art), আর্ট দেখে ভাবুন, নতুন কিছু শিখুন (UX/UI, ব্র্যান্ডিং), মানুষের আবেগ বোঝার চেষ্টা করুন 
• অ্যানালিস্ট সাইড ডেভেলপ করতে: Excel শেখা, Google Analytics/Looker Studio ব্যবহার করা, ফিনান্সিয়াল মডেলিং প্র্যাকটিস করা, কোর্স করা (LinkedIn Learning/ Coursera)
  

২. সঠিক কো-ফাউন্ডার খুঁজুন

আপনি যদি আর্টিস্ট হন, তাহলে আপনার দরকার এমন একজন পার্টনার যিনি অ্যানালিস্ট টাইপ।

বাংলাদেশে অনেক সফল কোম্পানি দুজন বিপরীতধর্মী কো-ফাউন্ডার নিয়ে গড়া—একজন রিস্ক নেয়, আরেকজন তা কাঠামোর মধ্যে আনেন।

৩. প্রতিদিন ছোট ছোট সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করুন

আপনি যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ভাবুন—“আমি এটা আর্টিস্ট হিসেবে নিলাম, না অ্যানালিস্ট হিসেবে?”

এই প্রশ্ন আপনার চিন্তাধারাকে ব্যালেন্স করতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে

Pathao যখন শুরু হয়, তারা চেয়েছিল “ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা দূর করতে।” এই চিন্তা আর্টিস্ট-ভাবনার ফল।

কিন্তু তারা পরে ডেটা দেখে দেখেছে—লোগো পরিবর্তন, ট্রিপ চার্জিং অপশন, পার্টনার কমিশন—সব কিছু অ্যানালিস্ট মনোভাবেই এসেছে।

10 Minute School প্রথমে ইউটিউব চ্যানেল দিয়ে শুরু করে। কিন্তু আজ তারা ফানেল, রিটেনশন, কাস্টমার রিভিউ—সব কিছুর পিছনে অ্যানালাইসিস রাখে।

আপনিও হতে পারেন সেই “দুই-চোখ বিশিষ্ট” ফাউন্ডার

একটা চোখে দেখবেন কল্পনা—স্বপ্ন, আবেগ, সৃষ্টিশীলতা। আরেকটা চোখে দেখবেন বাস্তবতা—ডেটা, বিশ্লেষণ, স্কেল।

এই দুই চোখে যদি আপনি দেখেন, তবেই আপনি পুরো চিত্রটা দেখতে পারবেন।

এবং তবেই আপনি শুধু আইডিয়া তৈরির মানুষ হবেন না—একজন সত্যিকারের “builder” হয়ে উঠবেন।

সফল ফাউন্ডার মানে শুধু টাকা ইনকাম করা নয়, বরং এমন কিছু তৈরি করা যা মানুষকে বদলে দেয়।

তাই আজ থেকে ভাবুন—আপনার ভিতরে আর্টিস্ট আছে তো? অ্যানালিস্টও আছে তো? যদি না থাকে, তাহলে সময় এসেছে দুটোই গড়ে তোলার।