বুধবার, আগস্ট ২০, ২০২৫
HomeWellbeingMental Healthযে রোগে আক্রান্ত হলে আর হাসতে পারবেন না! তাহলে কি করা উচিত?

যে রোগে আক্রান্ত হলে আর হাসতে পারবেন না! তাহলে কি করা উচিত?

একবার কল্পনা করুন—আপনার প্রিয় বন্ধুর বিয়েতে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে। কেউ মজার কৌতুক বলছে, কেউ পুরনো স্মৃতি মনে করে চোখে জল এনে ফেলছে হাসতে হাসতে। কিন্তু আপনি চুপচাপ বসে আছেন। মুখে একটুও হাসি নেই, মনেও না। হাসতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু পারেন না।

না, এটা মানসিক বিষণ্নতা নয়। এটা একটা বিরল, কিন্তু বাস্তব রোগ—“Gelotophobia”—মানে “হাসতে পারার অক্ষমতা” বা “হাসিকে ভয় পাওয়া”।

হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। এমন একটি মানসিক ও নিউরোলজিক্যাল অবস্থা রয়েছে, যেখানে মানুষ আর ঠিকভাবে হাসতে পারে না, বা হাসার পরিস্থিতিতে অস্বস্তি অনুভব করে। চলুন, আজ আমরা জানি সেই রহস্যময় রোগের কথা, তার কারণ, প্রভাব এবং—সবচেয়ে জরুরি—আমরা কীভাবে এই অবস্থাকে বুঝে সহানুভূতির সাথে মোকাবিলা করতে পারি।

Gelotophobia আসলে কী?

“Gelotophobia” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ “gelos” (হাসি) এবং “phobos” (ভয়) থেকে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি:

  • হাসিকে ভয় পান
  • মনে করেন, অন্যরা তার হাসির পাত্র বানাচ্ছে
  • হাসির পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করেন
  • নিজের মুখের বা শরীরের প্রকাশ নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন থাকেন
  • এমনকি হাসাহাসি শুনলে তারা আতঙ্কিত বা রেগে যান

Gelotophobia-তে আক্রান্ত অনেকেই ছোটবেলায় বা কিশোর বয়সে অপমান, বুলিং, কিংবা সামাজিক অবহেলার শিকার হয়ে থাকে। মজার ছলে কেউ বলেছে, “তোর হাসি তো ভয়ানক!” কিংবা “তুই হাসলি মানেই কিছু একটা গণ্ডগোল আছে!”—এই ধরনের মন্তব্যগুলো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

হাসতে না পারার কষ্ট কেমন?

আপনি জানেন কি? হাসা শুধু আনন্দের প্রকাশ নয়—এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক ও শারীরিক অভ্যাস। হাসলে:

  • কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) কমে যায়
  • ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে
  • সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়

তাই, যখন কেউ হাসতে পারে না বা হাসিকে ভয় পায়, তখন সে শুধু একা হয়ে পড়ে না—তার শরীর ও মনের ওপরও এর প্রভাব পড়ে।

গবেষণা কী বলছে?

জার্মান গবেষক ড. মাইকেল টিটজ ২০০৮ সালে Gelotophobia নিয়ে প্রথম গভীরভাবে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, এই অবস্থার শিকড় সাধারণত শৈশব বা কৈশোরের সামাজিক অপমান বা মানসিক ট্রমায় লুকিয়ে থাকে।

অনেক সময় শিক্ষক বা পরিবারেও এমন আচরণ করা হয়—যা শিশুকে হাসতে বা প্রকাশ করতে নিরুৎসাহিত করে। ফলাফল—বড় হয়ে ওঠা একজন ভীত, সংকোচাপূর্ণ মানুষ, যার পক্ষে আর হাসা স্বাভাবিক থাকে না।

তাহলে করণীয় কী?

যদি আপনি নিজে বা আপনার পরিচিত কেউ এই সমস্যার মুখোমুখি হন, তাহলে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলতে পারেন:

১. নিজেকে দোষ দেবেন না

Gelotophobia কোনো ‘খারাপ অভ্যাস’ নয়। এটা একটা বাস্তব মানসিক অবস্থা। আপনি যেমন দুঃখিত হলে কাঁদেন, তেমনি কেউ কেউ হাসির পরিবেশে ভয় পেতে পারেন।

২. নিজের অনুভূতির সাথে বন্ধুত্ব করুন

যখনই হাসির পরিস্থিতিতে অস্বস্তি হয়, তখন নিজেকে প্রশ্ন করুন—“আমি কি অপমানিত হচ্ছি, নাকি এটা নিছক মজা?” সময়ের সাথে আপনি পার্থক্য করতে শিখবেন।

৩. বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিন

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বললে আপনি বুঝতে পারবেন এই ভয়টা কোথা থেকে এসেছে। CBT (Cognitive Behavioral Therapy)-এর মতো থেরাপি Gelotophobia মোকাবিলায় কার্যকর।

৪. পজিটিভ সঙ্গ এবং কনটেন্ট বেছে নিন

মন ভালো রাখে এমন ভিডিও, মজার বই, ইতিবাচক গল্প—এসব আপনার মনকে হাসির পরিবেশে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করে তুলবে।

৫. সাপোর্টিভ বন্ধু বেছে নিন

যারা আপনাকে নিয়ে হাসে না, বরং পাশে থাকে—তাদের সঙ্গেই সময় কাটান। একটা নিরাপদ আবেগঘন পরিবেশ এই ভয় কাটাতে সাহায্য করে।

হাসি শুধু মজার বিষয় না, এটা বাঁচার উপায়

চট্টগ্রামের এক স্কুলশিক্ষক বলেছিলেন—“আমি একসময় এমনই ছিলাম, ক্লাসে কেউ হাসলে ভাবতাম আমাকে নিয়ে হাসছে। পরে নিজের মেয়ের মাধ্যমেই বুঝলাম, সবাই সবসময় আপনাকে লক্ষ্য করছে না। আপনি নিজেই আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু—হাসুন, কারণ আপনি তার যোগ্য।”

আমাদের সমাজে অনেক সময় “কঠোরতা” বা “চুপচাপ থাকা” বোঝায় পরিণত মানুষ হওয়া। কিন্তু আসলে হাসতে পারা মানে হলো মনের পরিপক্বতা, মানসিক শক্তি। আপনি যদি আজ হাসতে না পারেন—তাও ঠিক আছে। কিন্তু যদি ইচ্ছা থাকে, চেষ্টা করুন, ধীরে ধীরে। একদিন ঠিক পারবেন।

Gelotophobia মানেই আপনি অন্যরকম মানুষ—এমন নয়। বরং আপনি এমন একজন মানুষ, যিনি অভিজ্ঞতার কারণে একটু বেশি সচেতন, একটু বেশি সংবেদনশীল। আপনার হাসি হয়তো চাপা পড়ে আছে, কিন্তু তা হারিয়ে যায়নি।

আজকে নিজেকে প্রশ্ন করুন—

“আমি কি আমার অনুভূতিকে ভয় পাচ্ছি?”

“নাকি আমি তাকে বোঝার চেষ্টা করছি?”

আপনার উত্তরেই লুকিয়ে আছে হাসার নতুন সূচনা। কারণ হাসি শুধু ঠোঁটে নয়, সেটা শুরু হয় ভিতর থেকে। আর আপনার সেই ভিতরের আলো জ্বালানোর জন্য দরকার শুধু একটুখানি সাহস, একটুখানি ভালোবাসা—নিজের জন্য।

হাসি ফিরে আসুক—আপনার নিজের মতো করে, আপনার নিজের সময়মতো। 

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular