ভাবুন তো, মেঘনার পাড়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা এক ছেলেটি—যার বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে কাঁধে, দিনের বেলা ক্লাস আর রাতে কলসেন্টারের চাকরি, মাঝখানে স্বপ্নগুলো বারবার ধাক্কা খাচ্ছে বাস্তবতার দেয়ালে। কিন্তু সেই ছেলেটিই আজ হাঁটছেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের পথে, হাতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি।
এই গল্পটা কোনো সিনেমার নয়, নরসিংদীর রায়হান মিয়ার জীবনের বাস্তব গল্প।
স্বপ্নের বীজ : গ্রামের স্কুল থেকে হার্ভার্ডের ক্লাসরুম
মেঘনাপারের গ্রামে বেড়ে ওঠা রায়হান ছোটবেলা থেকেই ছিলেন কৌতূহলী। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও যখন আশপাশের সবাই রায়পুরার কোনো কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবছিল, তখন তিনি খুঁজছিলেন দেশসেরা কলেজে পড়ার সুযোগ। নিজের চেষ্টাতেই খুঁজে পান নটর ডেম কলেজের নাম। সমস্যা ছিল—ঢাকায় গিয়ে ভর্তি ফরম জমা দেওয়ার মতো কেউ নেই।
তাহলে কী করলেন?
একাই ট্রেনে উঠে বসেন ঢাকার পথে। ভয়, অনিশ্চয়তা, উত্তেজনা—সব মিলিয়ে এক সাহসী যাত্রা, যা তাঁর স্বপ্নকে এগিয়ে দিল অনেকটা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর স্বপ্নের নতুন দিগন্ত
নটর ডেম কলেজের পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে। এখানেই শুরু হয় তাঁর বড় স্বপ্নের পথচলা।
একদিন এক শিক্ষক ক্লাসে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিয়ে বলেছিলেন। সেই মুহূর্ত থেকেই রায়হানের চোখে ভেসে ওঠে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের নাম। মনে মনে ঠিক করে নেন—“যদি পড়ি, হার্ভার্ডেই পড়ব।”
তখন থেকেই তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন। কোয়ান্টিটেটিভ কোর্সগুলোতে ভালো করতে হবে জেনে সেগুলোকে আলাদা গুরুত্ব দেন। চার বছরের অনার্সে সব কোয়ান্টিটেটিভ কোর্সে এ-প্লাস পান। এর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত হন—কারণ সেটিও হার্ভার্ডের ভর্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাবাকে হারানো আর জীবনের কঠিন মোড়
কিন্তু তখনই নেমে আসে জীবনের সবচেয়ে বড় ঝড়। ২০১০ সালে অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষেই বাবাকে হারান তিনি। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। সংসার চালানোর জন্য শুরু করেন কলসেন্টারের রাতের শিফটে চাকরি।
দিনে ক্লাস, রাতে কাজ—এর ফলে পড়াশোনায় প্রভাব পড়ে, রেজাল্টও খারাপ হয়।
তবুও হাল ছাড়েননি। চাকরি ছেড়ে খুঁজে নেন নতুন পথ। শুরু করেন একটি ভর্তি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা। সেই আয়ে সংসার চালিয়েছেন, আবার পড়াশোনার খরচও সামলেছেন।
বিসিএস প্রস্তুতি আর শিক্ষাজীবনের সমান্তরাল লড়াই
মাস্টার্সে পড়ার সময় রায়হান দিনের প্রথম ভাগে বিভাগীয় পড়াশোনা, আর পরের ভাগে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতেন। পরিশ্রমের ফলও পান—প্রথমবার অংশ নিয়েই বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপরেও পারিবারিক আর্থিক সংকট তাঁকে সরকারি চাকরিতে স্থির হতে বাধ্য করে। সাবরেজিস্ট্রারের চাকরির পাশাপাশি তিনি হার মানেননি নিজের স্বপ্নকে।
হার্ভার্ড জয় : দেরিতে হলেও পূর্ণ হলো স্বপ্ন
সময় লেগেছে অনেকটা। চাকরি, সংসার, সন্তান—সব মিলিয়ে স্বপ্ন যেন অনেকটাই দূরে সরে যাচ্ছিল। তবুও তিনি থামেননি। একসময় আবার মনোযোগ দেন উচ্চশিক্ষার আবেদনে।
অবশেষে সেই দীর্ঘ প্রস্তুতির ফল এসেছে—হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে পাবলিক পলিসি বিষয়ে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ পেয়েছেন রায়হান মিয়া। সরকারি চাকরি থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে এই মাসেই পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
রায়হানের গল্প কেন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশে আমরা প্রায়ই শুনি—“বিদেশে পড়া তো অনেক টাকার ব্যাপার”, “সরকারি চাকরির মানুষ আবার নতুন করে পড়াশোনা করবে কেন?”, কিংবা “গ্রামের ছেলে-মেয়েদের জন্য বড় সুযোগ কই?”।
রায়হান মিয়া প্রমাণ করেছেন—টাকা, জায়গা বা ব্যাকগ্রাউন্ড কোনো কিছুই স্বপ্ন থামাতে পারে না, যদি ইচ্ছাশক্তি আর পরিকল্পনা থাকে।
তাঁর গল্প অনুপ্রেরণা হতে পারে ঢাকার কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের জন্য, আবার নরসিংদীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের জন্যও।
রায়হানের জীবনের গল্প থেকে আমাদের জন্য কিছু স্পষ্ট শিক্ষা পাওয়া যায়-
- স্বপ্ন দেখা কখনো ছাড়বেন না –
চাকরি, সংসার, সন্তান—সব সামলেও তিনি নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। - পরিকল্পনা আর অধ্যবসায় জরুরি – হার্ভার্ডের জন্য কোয়ান্টিটেটিভ কোর্সে ফোকাস করা কিংবা স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত থাকা তাঁর প্রস্তুতিকে শক্ত করেছে।
- কঠিন সময়েও বিকল্প পথ খুঁজুন –
কলসেন্টারের চাকরি থেকে কোচিং-এ শিক্ষকতা—প্রতিটি ধাপে তিনি থেমে যাননি।
- দেরিতে হলেও সঠিক সময় আসবেই –
হয়তো ২০১০ সালের পর থেকেই স্বপ্নটা অনেক দূরে মনে হচ্ছিল, কিন্তু অবশেষে তা পূরণ হয়েছে।
নরসিংদীর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে পৌঁছানো রায়হান মিয়ার গল্প শুধু একজন মানুষের অর্জনের কাহিনি নয়—এটা হাজারো তরুণ-তরুণীর জন্য এক অমূল্য অনুপ্রেরণা।
তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ঝড় যত বড়ই হোক, স্বপ্ন যদি জীবিত থাকে তবে একদিন তা ঠিকই পূরণ হয়।