ঈদের সকাল। জানালার কাঁচে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। বাইরে একটানা ঝিরঝিরে বৃষ্টি, রাস্তায় পানি জমে আছে। কিন্তু বাড়ির ভেতর কোরবানির ঈদের প্রস্তুতির ব্যস্ততা তুঙ্গে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে গরুর মাংসের রেজালার ঘ্রাণ, উঠোনে চলছে গরু জবাইয়ের তোড়জোড়।
সেই সকালেই কলেজপড়ুয়া মেয়ে তানিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে—আজ কী পরবে? এই ভেজা ভ্যাপসা আবহাওয়ায় কি শাড়ি ঠিক হবে? আর মা তো রান্নাঘরে একা যুদ্ধ করছেন, তাকে কি সাহায্য করবে?
এই গল্পটা শুধু তানিয়ার নয়, হাজারো মেয়ের ঈদের গল্প। বৃষ্টির ঈদে কীভাবে ফ্যাশন ঠিক রাখা যায়, আর ঘরের কাজে মা-বাবার পাশে থাকা যায়—সেই কথাই বলি আজকের লেখায়।
বর্ষায় ঈদের ফ্যাশন: স্টাইলও, স্বস্তিও
বর্ষাকালে ঈদ মানেই একটু ঝামেলা—ভেজা জামা, কাদা-পানি, ভ্যাপসা গরম। তাই এই সময় পোশাক বাছাইয়ে চাই কিছু বাড়তি সতর্কতা। ঈদের দিনে যেমন দেখতে ভালো লাগবে, তেমনই আরামদায়কও হতে হবে।
১. হালকা ও নরম কাপড় বেছে নিন
- সুতির কুর্তি বা টিউনিক: হালকা রঙের ফুলহাতা কুর্তি বা টিউনিক সুতির কাপড়ে দারুণ আরামদায়ক। হালকা বৃষ্টিতেও সহজে শুকিয়ে যায়।
- প্যালাজ্জো বা ওয়াইড লেগ প্যান্ট: পা ঘেমে যায় এমন টাইট জিন্স নয়, ঢিলেঢালা প্যান্ট বা পালাজ্জো বেশি উপযুক্ত। হাঁটাহাঁটি করলে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়।
- সেমি-ফরমাল লং গাউন বা ক্যাজুয়াল শাড়ি: যারা ঐতিহ্য বজায় রাখতে চান, তারা সুতির আটপৌরে শাড়ি পরতে পারেন। হালকা ফ্লোরাল প্রিন্ট, কটন বা হ্যান্ডলুম শাড়ি এই আবহাওয়ার জন্য দারুণ।
২. বৃষ্টিতে মানানসই জুতো
- রাবারের ফ্ল্যাট স্যান্ডেল বা ক্রকস: বর্ষায় চামড়ার জুতো না পরাই ভালো। কাদা-পানিতে ফেলার ভয় নেই, আবার পরিষ্কারও করা সহজ।
- ব্লক হিল বা ওয়েজ হিল: যদি হালকা স্টাইল চান, তবে ব্লক হিল পড়লে মাটিতে পা ডোবে না, হাঁটা সহজ হয়।
৩. হিজাব বা ওড়নায় বৃষ্টির ছোঁয়া
- যারা হিজাব পরেন, তারা হালকা সুতি বা ক্রেপ ফেব্রিক বেছে নিন। বৃষ্টিতে ভারী বা সিল্ক হিজাব ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে। হালকা একরঙা হিজাবে ফ্যাশনের সঙ্গে স্বস্তি আসে।
মায়ের পাশে মেয়েরা: ঈদের ব্যস্ততায় হৃদয়ের অংশীদার
ঈদ মানেই মায়ের সারা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম। রান্না, অতিথি আপ্যায়ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা—সব মিলিয়ে ঈদের আনন্দ যেন কখনো কখনো ক্লান্তিতে পরিণত হয়। এই সময় মা’য়ের পাশে মেয়েরা হয়ে উঠতে পারে সাহসী সহচর।
১. রান্নাঘরে মায়ের ডান হাত
- মাংস পরিষ্কারে সাহায্য: গরুর কোরবানির পর কাঁচা মাংস পরিষ্কার করা একটি বড় কাজ। মেয়েরা সেই কাজে সক্রিয় হলে মায়ের অনেক চাপ কমে যায়।
- সবজি কাটা, সালাদ বানানো, টেবিল সাজানো: ছোট ছোট কাজ একসাথে করলে ঈদের রান্নায় গতি আসে।
- গরুর চর্বি আলাদা করা, মাংস ভাগ করে ফ্রিজে রাখা: অনেক বাড়িতেই এই কাজগুলো মা একা করে থাকেন। অথচ মেয়েরা এগিয়ে এলে এই কাজগুলো আনন্দে রূপ নেয়।
২. অতিথি আপ্যায়নে দায়িত্ব ভাগাভাগি
- চা পরিবেশন, খেজুর দেওয়া, অতিথির জন্য পানির গ্লাস নিয়ে আসা—এসব ছোট ছোট কাজে আন্তরিকতা দেখালে মা যেমন খুশি হন, তেমনি অতিথিও প্রশংসা করেন।
৩. ইসলামের আলোকে পারিবারিক দায়িত্ব
রাসুল (সা.) নিজেও ঘরের কাজে সহায়তা করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন—“তিনি নিজের কাপড় সেলাই করতেন, ঘরের কাজ করতেন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেন।”
মেয়েরা যদি ঈদের দিন এই সুন্নাহ রীতি অনুসরণ করে, তাহলে তা হয়ে ওঠে ইবাদতের মতো সম্মানজনক।
টিনএজার বা তরুণীদের জন্য কিছু বাস্তবিক পরামর্শ
১. নিজেকে সাজান, তবে কাজকে এড়িয়ে নয়
ঈদের দিন নিজের সাজগোজ যেমন দরকার, তেমনি পরিবারকে সময় দেওয়াও জরুরি। একটু সময় মাকে দিন—বিশ্বাস করুন, সেটাই হবে তার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।
২. বৃষ্টির দিনে বাড়িতে অতিথি বেশি এলে, বসার জায়গা, ভিজে জামাকাপড় রাখার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিজে নিন।
৩. ছোট ভাইবোনদের সামলানো ও তাদের খেয়াল রাখাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
৪. ঈদের সালাত, কোরবানির তাৎপর্য বুঝিয়ে দিন ছোটদের, এতে ঈদের শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে পরিবারে।
ঈদের আনন্দ তখনই পূর্ণ, যখন আমরা একসঙ্গে থাকি
বৃষ্টির দিনে ঈদ একটু কষ্টকর হলেও, মেয়েরা যদি স্মার্টভাবে পোশাক নির্বাচন করে আর মায়ের পাশে দাঁড়ায়, তবে সেটাই হয়ে ওঠে প্রকৃত ঈদের আনন্দ। রেইন-ফ্রেন্ডলি ফ্যাশনের পাশাপাশি ঘরের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া মানে হলো, ঈদের রঙ আরও উজ্জ্বল করে তোলা।
তানিয়া যেমন মাকে রান্নায় সাহায্য করল, ছোট ভাইকে গোসল করিয়ে দিল, আর তারপর এক কাপ চা নিয়ে মা’র পাশে গিয়ে বসলো—ঠিক তেমনি আপনি-আমি সবাই পারি এই ঈদকে শুধু ভোজন আর সাজসজ্জার নয়, ভালোবাসা আর সহমর্মিতার উৎসবে পরিণত করতে।