সবার জীবনেই এমন সময় আসে, যখন নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। পরিবার, সমাজ বা কাছের মানুষরা যখন বলে—“তুমি কিছুই করতে পারবে না”, তখন সেটা বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। কিন্তু কেউ কেউ ঠিক তখনই ভেতরে জেদ পুষে নেয়। মনে মনে বলে—“একদিন তোমাদের প্রমাণ করে দেখাবো!”
এই কথাটা বলেই শুরু হয় নতুন পথচলা—একজন চলতি উদ্যোক্তার।
চলতি উদ্যোক্তা মানে এমন একজন মানুষ, যে নিজের জীবন থেকে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে। যিনি বড় কিছু ভাবার আগেই ছোট কিছু দিয়ে শুরু করেন। তার হাতে হয়তো বিশাল মূলধন নেই, কিন্তু আছে—সাহস, চেষ্টা আর হাল না ছাড়ার মানসিকতা।
গল্পটা শুরু হয় ছোট থেকেই
সবার নজরে না পড়লেও, আমাদের আশেপাশেই এমন বহু গল্প জন্ম নেয়। যেমন, ঢাকা শহরের এক তরুণ। পরিবারে কেউ তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। চাকরি না পাওয়ায় একসময় সবাই ভাবতে শুরু করলো—“এই ছেলেটা বোধহয় কোনোদিন কিছু করতে পারবে না।”
কিন্তু সে থেমে থাকেনি।
একদিন সকালে হঠাৎ করেই সে ঠিক করলো, একটা ছোট ট্রলিতে চা আর লেবু পানি বিক্রি করবে। কেমন করে যেন সে বুঝে ফেলেছিল, রাস্তায় মানুষ ঘামছে, ক্লান্ত—তাদের দরকার এক কাপ ঠান্ডা স্বস্তি। সে শুরু করলো মাত্র ৫০০ টাকার পুঁজিতে।
প্রথম দিন বিক্রি হলো ২০ কাপ। দ্বিতীয় দিনে হলো ৪০ কাপ। তৃতীয় দিন সে যুক্ত করলো—“টক-ঝাল লেবু পানি”, একটু ভিন্ন স্বাদ, একটু নিজস্বতা।
কোনোদিনই সে বড় প্ল্যান করে বসে থাকেনি। বরং রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষ দেখেছে, কথা বলেছে, শিখেছে। শিখেছে—মানুষ কী চায়, কখন চায়, কেন চায়।
এই শেখাটাই তাকে বদলে দিয়েছে।
‘চলতি উদ্যোক্তা’ মানে কী?
চলতি উদ্যোক্তা বলতে বুঝি এমন একজন মানুষকে:
- যিনি আজ থেকেই কিছু একটা শুরু করেন, কাল নয়
- যিনি যা কিছু হাতে আছে তাই দিয়েই কাজে নেমে পড়েন
- যিনি বাজার না বুঝেও সাহস করে বাজারে নামে, আর সেখান থেকেই শেখেন
- যিনি ছোট উদ্যোগকে বড় স্বপ্নে রূপ দেন, কিন্তু ধাপে ধাপে
সফল হওয়ার চাবিকাঠি
চলতি উদ্যোক্তার সাফল্যের রহস্য খুব জটিল কিছু না। বরং খুবই সাধারণ কিন্তু উপেক্ষিত কিছু বিষয়:
- দৃষ্টি দিন মানুষের সমস্যার দিকেট্রাফিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ কী খুঁজছে? গরমে ক্লান্ত মানুষ কী চায়?
- সামান্য কিছু দিয়েই শুরু করুন
ধরা যাক, ৫০০ টাকায় লেবু পানি বা ১০০০ টাকায় কেক বানানো শিখে বিক্রি - গ্রাহকের কথা শোনার অভ্যাস গড়ুন
তারা যদি বলে—“আরেকটু ঠান্ডা হলে ভালো হতো”, তখনই ঠিক করুন - পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে বদলানশীতে চা, গ্রীষ্মে আইসচা; উৎসবে ফিউশন খাবার
- নিজেকে ছোট মনে করবেন না
একটা কাপ চা দিয়েও একটা ব্র্যান্ড তৈরি করা সম্ভব, যদি আপনি সেটা বিশ্বাস করেন
আরেকটি অনুপ্রেরণার গল্প
চট্টগ্রামের রুমি নামের এক তরুণী। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছিলেন। না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। একদিন মায়ের হাতে বানানো আচার নিয়ে গেলেন বান্ধবীর বাসায়। এতটা প্রশংসা পেয়ে ভাবলেন—“এটা যদি সবাই খেতে চায়, তাহলে আমি কেন না বিক্রি করি?”
বাসা থেকে বানাতে শুরু করলেন। একটা ফেসবুক পেজ খুলে ৫ কৌটা দিয়ে অর্ডার নিলেন। প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হলো ১০ কৌটা, দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩০। তৃতীয় সপ্তাহে ক্রেতারা ফিরে এসে বললো, “আর একটু ঝাল হলে ভালো হতো।” তিনি শুনলেন, বদল করলেন।
আজ রুমি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় করছেন। এবং সবটাই নিজের ঘর থেকেই।
চলতি উদ্যোক্তার জন্য ৫টি সহজ ব্যবসা আইডিয়া
আইডিয়া | কেন এটা সহজ | কী দিয়ে শুরু করবেন |
হোমমেড খাবার ডেলিভারি | অফিস/বাসায় চাহিদা বেশি | মোবাইল, রান্না, ফেসবুক |
মোবাইল সার্ভিসিং | সবাই মোবাইল ব্যবহার করে | ট্রেনিং, টুলস, প্রচার |
অনলাইন টিউশন | ছাত্র-ছাত্রীর অভাব নেই | ১টা ফোন, ১টা Zoom অ্যাকাউন্ট |
গরম-ঠান্ডা পানীয় | রাস্তায় দ্রুত বিক্রি হয় | ঠেলা, পানীয় উপকরণ |
ফেসবুক লাইভ বিক্রি | নিজস্ব পণ্য থাকলে দ্রুত পরিচিতি | ১টা মোবাইল, পেজ ও ক্যামেরা |
প্রমাণটা অন্যকে না, নিজেকেই দিন
এই সমাজে অনেকেই আপনাকে বলবে—“তুমি পারবে না”, “তোমার কিছু হবে না”। সেই সময় আপনি দুইটা কাজ করতে পারেন—
১. চুপ করে সেসব কথায় ভেঙে পড়তে পারেন
২. অথবা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলতে পারেন—“দেখিয়ে দেবো!”
চলতি উদ্যোক্তা মানে সেই দ্বিতীয় ধরনের মানুষ। যারা না বললেও হাল ছাড়েন না, বরং নিজের পথটা নিজেই গড়ে নেন।
আজ আপনি যদি ৫০০ টাকাও হাতে রাখেন, তাহলেও কিছু একটা শুরু করতে পারেন। আর সেটা যদি মন দিয়ে করেন, তাহলে একদিন ঠিকই মানুষ বলবে—“ও তো নিজে নিজেই সব করে দেখিয়েছে!”
আজই শুরু করুন। পথটা আপনার হাতেই।