মঙ্গলবার, জুলাই ২২, ২০২৫
HomeWellbeingMental Healthবাচ্চাদের ট্রমা কাটিয়ে ওঠার পথ – ডাক্তারদের পরামর্শে অভিভাবকের করণীয়

বাচ্চাদের ট্রমা কাটিয়ে ওঠার পথ – ডাক্তারদের পরামর্শে অভিভাবকের করণীয়

“মা, কাল যদি আবার প্লেনটা আসে?”

মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনার পর ৮ বছরের এক শিক্ষার্থী এ প্রশ্ন করছিল তার মাকে। কয়েক দিন আগের সেই ভয়াবহ মুহূর্ত যেন বারবার ফিরে আসছে তার ছোট্ট মনে। চোখে-মুখে ভয়, রাতে ঘুম আসে না, আর খেলাধুলার চঞ্চলতা হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে।

এমন দুর্ঘটনা বা ভয়াবহ ঘটনা শুধু আহত বা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের নয়, আশপাশে থাকা অন্যান্য বাচ্চাদের মনেও গভীর ছাপ ফেলে। ছোট্ট বয়সে মস্তিষ্কের বিকাশ চলছে পূর্ণ শক্তিতে, তাই এ ধরনের মানসিক আঘাত তাদের আত্মবিশ্বাস, নিরাপত্তাবোধ ও স্বাভাবিক আনন্দকে আঘাত করতে পারে।

চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক সময়ে অভিভাবকের মনোযোগ ও যত্নই পারে শিশুর ভয় ও অস্থিরতাকে জয় করতে।

ট্রমা কীভাবে শিশুদের প্রভাবিত করে?

ট্রমা মানে এমন এক মানসিক আঘাত যা ভয়, অসহায়ত্ব বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে।

  • যেমন বিমান দুর্ঘটনা, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, রোড অ্যাক্সিডেন্ট, ভূমিকম্প বা হঠাৎ প্রাণহানি।
  • এর ফলে শিশুর মধ্যে দেখা দিতে পারে – ঘুমের ব্যাঘাত, দুঃস্বপ্ন, একা থাকতে ভয়, চুপচাপ হয়ে যাওয়া, হঠাৎ কান্না বা রাগ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন:

“শিশুরা অনেক সময় নিজের ভয়কে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। তাই অভিভাবকের উচিত তাদের অনুভূতিকে মন দিয়ে শোনা ও বোঝা।”

শিশুর ট্রমা কাটিয়ে ওঠার ৭টি কার্যকর ধাপ

১. শিশুর সাথে কথা বলুন, তাকে শোনার জায়গা দিন

শিশুকে জিজ্ঞাসা করুন—“তুমি কী অনুভব করছ?”

তার ভয় বা দুঃস্বপ্নের কথা মন দিয়ে শুনুন। “এসব ভুলে যা” বলার বদলে বলুন—“তোমার ভয় আমি বুঝতে পারছি।”

২. নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি করুন

শিশুর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ভর করে থাকতে পারে। তাকে আশ্বস্ত করুন যে সে নিরাপদ। রাতে ঘুমের আগে তার পাশে বসে গল্প বলুন বা প্রিয় খেলনা হাতে দিন।

৩. দৈনন্দিন রুটিন চালু রাখুন

আতঙ্কের পরিবেশে পড়াশোনা বা খেলার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রুটিন বজায় রাখুন। নিয়মিততা শিশুর মস্তিষ্কে স্থিতিশীলতার অনুভূতি ফিরিয়ে আনে।

৪. ভয়াবহ খবর ও ছবি এড়িয়ে চলুন

টিভি নিউজ, সোশ্যাল মিডিয়ার ভয়াবহ ভিডিও শিশুদের ট্রমা আরও বাড়িয়ে তোলে। তাদের সামনে এমন কন্টেন্ট না দেখানোই ভালো।

৫. খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন

আঁকা, গল্প লেখা, গান শোনা বা লুকোচুরি খেলার মতো সৃজনশীল কাজ শিশুর মনের চাপ কমায়।

৬. নিজেকে শান্ত রাখুন

অভিভাবক হিসেবে আপনি যদি আতঙ্কিত হন, শিশুও সেই ভয় অনুভব করে। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে তাকে আশ্বস্ত করুন।

৭. প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নিন

৩-৪ সপ্তাহ পরও যদি শিশু অস্থিরতা বা ভয় কাটাতে না পারে, দ্রুত শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

ট্রমার বৈজ্ঞানিক দিক

গবেষণা বলছে, ট্রমাটিক ঘটনার পর শিশুদের মস্তিষ্কে কোর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) বেড়ে যায়। এতে ঘুম, ক্ষুধা ও মনোযোগে সমস্যা তৈরি হয়।

এক জরিপে দেখা গেছে, দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করা ৫ থেকে ১২ বছরের শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩০% পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এর লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটের গল্প

আমাদের সমাজে ট্রমা সম্পর্কে সচেতনতা তুলনামূলকভাবে কম। যেমন মিলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনার পর অনেক বাবা-মা সন্তানের ভয়কে হালকাভাবে বলেছেন—“ওসব ভাবিস না।”

কিন্তু চট্টগ্রামের শিলা আক্তারের উদাহরণ ভিন্ন কথা বলে।

“আমার ছেলে রোড অ্যাক্সিডেন্ট দেখার পর এক সপ্তাহ রাতে ঘুমাতে পারতো না। ডাক্তার বললেন প্রতিদিন ১৫ মিনিট আঁকতে ও গল্প বলতে। এক মাসেই সে আগের মতো হয়ে গেছে।”

  • শিশুকে প্রিয় গল্প বা খেলনা দিন।
  • ঘুমের আগে ২-৩ মিনিট শ্বাস-প্রশ্বাসের হালকা ব্যায়াম শেখান।
  • শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলুন যাতে তারা শিশুর আচরণ বুঝে সহায়তা করতে পারেন।

ট্রমা কোনো ছোট বিষয় নয়। একটি দুর্ঘটনা শিশুর মনে এমন গভীর ছাপ ফেলে, যা তার বড় হয়ে ওঠার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে সঠিক যত্ন, ভালোবাসা এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শে শিশুরা ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারে।

একটি নিরাপদ ও স্নেহময় পরিবেশ শিশুদের জন্য সবচেয়ে বড় ওষুধ। আপনার সন্তান যদি ভয় বা অস্থিরতা নিয়ে কথা বলে, তাকে সময় দিন। মনে রাখবেন, ভালোবাসা আর বোঝাপড়ার স্পর্শই ট্রমা কাটিয়ে উঠার প্রথম ধাপ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular